ন্যাটো’র ‘তোলা দুধ’ দিয়ে কি নেভানো যাবে মিসাইলের আগুন?
আমেরিকা কিংবা অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো এমনকি আজকের রাশিয়াও তাদের প্রয়োজনেই আন্তর্জাতিক শক্তিকে কাজে লাগায়, সহায়তা দেয়। প্রতিরক্ষার নাম নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে তারা চালায় আগ্রাসন। লিবিয়া, ইরাক, কুয়েত এগুলো কিছু দূর অতীতের স্মৃতি হলেও আফগানিস্তান তো এক্কেবারে এই সেদিনের, সিরিয়ার আগুন তো এখনও নেভেনি। এ দেশগুলোর ভয়াবহতার চিহ্ন এখনও সেসব দেশজুড়ে। জাতি হিসেবে তারা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সেসব তাণ্ডবের দগদগে ঘা। সে দেশগুলোতে ছিল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট, এ সুযোগে পরা শক্তিগুলো ঘাঁটি গেড়েছে এবং গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ ।
যুদ্ধ মানেই নৃশংসতা, যুদ্ধ মানে রক্তের হোলিখেলা, যুদ্ধ মানে শিশুদের রক্তাক্ত দেহগুলোর স্থিরচিত্র। যুদ্ধ মানে নারীর সম্ভ্রম নিয়ে পাশবিক উল্লাস। কপালে ভাঁজ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দেশান্তরিতে নাম লেখানো, মুহূর্তের মাঝে ছিন্নমূল হয়ে ওঠা মানুষ। লাশ-ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দিয়ে পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতার দম্ভ, সর্বোপরি ডলার-পাউন্ড-ইউরোর রক্তাক্ত ব্যবসা।
ইউক্রেন ন্যটো’য় যোগ দেবে কি দেবে না, সেটা সে দেশে সাধারণ মানুষের জন্য বড় ধরনের ইস্যু নয়। সে ইস্যু সরকারের। একটা দেশকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে দায় থেকেই আন্তর্জাতিক সমর্থন-সহযোগিতা কিংবা অন্য দেশের সাথে ট্রিটি বা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি ওরগেনাইজেশন’ এরকমই একটা চুক্তিবদ্ধ সংস্থা।
বলতে গেলে পুরোনো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটা শক্তি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ সংস্থাটি। যদিও বলা হয় এটা আংশিক সত্য। কারণ প্রচারণা আছে জোটের সৃষ্টি তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে: সোভিয়েত ‘সম্প্রসারণবাদ’ (?) কে রোখা, মহাদেশে উত্তর আমেরিকার শক্তিশালী উপস্থিতির মাধ্যমে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী সামরিকবাদের পুনরুত্থান নিষিদ্ধ করা এবং ইউরোপীয় রাজনৈতিক সংহতিকে উৎসাহিত করা।
এবং মূলত তা-ই হচ্ছে ইউক্রেন নিয়ে। রাশিয়ার পুরোনো প্রেম উতলে উঠেছে, আর সেজন্যই প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগের মুহূর্তেই বলেছেন, ইউক্রেনের মাটিতে তিনি তার নিজের দেশের ঘ্রাণ পান। আগ্রাসন থেকে হোক আর ইউরোপ আমেরিকার বলয় থেকে নিজেকে বাঁচাতে কিংবা নিবৃত্ত করতে হোক পুতিন কিন্তু তা-ই করেছেন। বাধিয়েছেন যুদ্ধ। মরছে মানুষ, আবারও ধ্বংসযজ্ঞে ভরে উঠছে নিটোল একটা দেশ।
আমেরিকানভিত্তিক একটা আইটি ফার্মের হয়ে কাজ করতেন ইউক্রেনের অধিবাসী মাক্স। সে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধারের একজন আমেরিকান বাংলাদেশী তার ওই সহকর্মীকে ফোন করেছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের বর্তমান অবস্থার কথা। মাক্স কাজে অত্যন্ত দক্ষ এক মানুষ, সেজন্য তাকে এর আগে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ দিয়ে আমেরিকা এনেছিলেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো এখনও মাক্স করে যাচ্ছিলেন দক্ষতার সাথেই।
কোম্পানির কর্ণধার (সিইও) তাকে বলেছিলেন, ভিসাতো আছে আবারও আসো আমেরিকায়। তখন যে কথাটি বলেছিল মাক্স, তা যুদ্ধের ভয়াল আর নির্মম-অসহায় চিত্রটা ফুটিয়ে তোলে। মাক্স তাকে বলেছিলেন, সে সুযোগ আমার নেই। আমরা বাংকারে রাত কাটাচ্ছি। ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ইউক্রেনের কোনো পুরুষের এখন বাইরে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা নেই। তাই তো ‘আমি আজ (২৭ ফেব্রুয়ারি) আমার পার্টনারকে (মেয়ে বন্ধু) বিদায় দিয়ে এলাম সীমান্তে। মাক্স বিষন্ন গলায় তখন শুধু এই-ই বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ৪৪ বছরের এক প্রাণবন্ত মানুষ। তার হয়তো কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। কিন্তু সময় মানুষকে যে নিয়ে আসতে পারে ইতিহাসের এক নির্ধারিত অধ্যায়ে, তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ ভলদিমির জেলেনস্কি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলেছেন ইউক্রেনের মানুষ একজন কমেডিয়ানকে দেশের রাষ্ট্রনায়ক বানিয়ে দেশটার দুর্যোগ নিয়ে এসেছে। তিনি কমেডিয়ান বটে। রাশিয়ান-ভাষী দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের ইহুদি বংশোদ্ভূত জেলেনস্কি ২০১৫ সালের টিভি স্যাটায়ার ‘সার্ভেন্টস অব দ্য পিপলে’ হাই স্কুল শিক্ষক হিসেবে অভিনয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তার চরিত্রটি একটি অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক তারকায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে এবং যার ফলে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সেই ভাইরাল হওয়া কমেডি চরিত্রের মতোই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছিলেন গোটা জাতিকে এবং ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষকে তিনি একই জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন হয়তো, কিন্তু তিনি কি রাজনীতির চিরাচরিত আন্তর্জাতিক আগ্রাসনের বিপরীতে দাঁড়াতে পেরেছেন কিংবা রাশিয়ার তুলনায় দুর্বল ভিতের একটা দেশ ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামরিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কৌশল রপ্ত করতে পেরেছেন কি?
সেই আশির দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে জেলেনস্কির আগে ইউক্রেনের আগের সরকারের (রাশিয়া সমর্থিত) আমলে ন্যাটোতে ইউক্রেনের অংশগ্রহণ করানো না গেলেও এখনকার সময়ে ন্যাটোর প্রভাব দেশটিতে প্রশস্ত হয়। কিন্তু রাশিয়া মনে করছে ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা তাদের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পূর্ব ইউরোপের সীমান্তে ন্যাটো বাহিনী এবং ক্ষেপণাস্ত্রের উপস্থিতির জন্য সৃষ্ট হুমকির কারণে রাশিয়াও তার নিরাপত্তার কৌশল নিয়ে হয়তো উদ্বিগ্ন। তাই সরাসরি যুদ্ধে নেমে গেলেন পুতিন। আলোচনা, কূটনৈতিক কূটচাল সবকিছু নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। শান্ত একটা দেশ ধ্বংস হতে শুরু হলো যুদ্ধের দামামায়।
স্বাভাবিকভাবেই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এর চরম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনকে মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা। ইতিহাসের এক বর্বরতম অধ্যায় হিসেবে তারা উল্লেখ করছেন পুতিনের কার্যক্রমকে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে এ নিয়ে আছে তুমুল আলোচনা। ব্রিটেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেছেন, পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ করছেন। তিনি ‘বিবিসি ব্রেকফাস্ট’ এ দেয়া এক ভাষ্যে বলেছেন, ‘পুতিনের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ রাখতে প্রক্রিয়া নিশ্চিত করছি।’
এ প্রসঙ্গে তিনি বসনিয়ান সাবেক প্রেসিডেন্ট রাডোভান কারাদজিক এর সে দেশটিতে মানুষ হত্যার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যুদ্ধাপরাধের জন্য তিনিও যুক্তরাজ্যের কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। ইউরোপের প্রত্যেক দেশের সাথে ব্রিটেনও রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ কারণে ইতিমধ্যে কয়েকশ মিলিয়ন পাউন্ডের সহায়তাও যাচ্ছে দেশটির পক্ষ থেকে। ব্রিটেনের সাধারণ জনগণকেও ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ব্রিটেনের গণমাধ্যমও স্বাভাবিক কারণেই রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুকে অমানবিক এক আগ্রাসন হিসেবে দেখছে। দেশটার সাধারণ মানুষও রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন শিশুসহ শত শত মানুষের হত্যাকারী হিসেবে দেশের মানুষ পুতিনকেই অভিযুক্ত করছে।
ব্রিটেনে সবচেয়ে ধাক্কা লেগেছে জ্বালানি তেলে। এর মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সাধারণ মানুষ যুদ্ধকেই দায়ী করছে। এ যুদ্ধ ব্রিটেনের জনজীবনে সরাসরি আঘাত হেনেছে। সেজন্যই সাধারণ জনগণের ক্রোধের মাঝেই আছেন পুতিন।
এ হিসেবে পৃথিবীর অন্য প্রভাবশালী দেশগুলো যুদ্ধের প্রতিবাদ করলেও মস্কোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না দক্ষিণ কোরিয়া, চীন। এমনকি ভারতও রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করছে না। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপেও যাচ্ছে না। তাহলে ইউক্রেনের আশার আলোটা কোথায়? একতরফাভাবেই যুদ্ধে রাশিয়া নেতৃত্ব নিচ্ছে। মরছে তারাও, মারছে শিশুসহ ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিক।
সেই আশি-নব্বইর দশকে উদীচীর অনুষ্ঠানগুলোতে একটা গান শোনতাম- ‘তোলা দুধে ফোলা বাঁচে না।” জেলেনস্কি যাদের ওপর আস্থা রেখে তার দেশটাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝে ফেলে দিলেন, তাতো তার দেশের মানুষ চায়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহায়তা কি পারবে রাশিয়ার মিসাইলকে রুখতে?
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সেনা পাঠানোর ঝুঁকি নেবে কি কোন রাষ্ট্র? যদিও বা পাঠায়, তা-ও খুব একটা ব্যাপক হবে না অর্থাৎ শুধু অর্থ দিয়ে কিংবা অবরোধ দিয়ে কি থামানো যাবে পুতিনের আগ্রাসন? যে হত্যার নির্মমতা চলছে ইউক্রেনে, তার কি অবসান হবে সহসা? শুধু অর্থ আর অবরোধ নামক ‘তোলা দুধ’ দিয়ে কি নেভানো যাবে মিসাইলের আগুন?
এইচআর/এএসএম