আলোচনার টেবিলে হোক যুক্তির যুদ্ধ
এ কথাটি আমরা আগেই বলেছি, তা আমাদের রাজনৈতিক সামরিক চিন্তার মধ্যে নিহিত এবং আমাদের বিশ্বাসের ভিত। কিন্তু যারা পরধনে মত্ত তারা তো আর আলোচনায় এসে নিজেদের চিন্তার খায়েস মেটাতে পারবে না, তাই আলোচনার টেবিল নয়, সামরিক অভিযানই তাদের নীতি ও আদর্শের মৌলিক আদল। ভ্লাদিমির পুতিন সেই আদর্শের মানুষ।
এখন ইউক্রেনের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে অস্ত্র, যাতে কম্যুনিস্ট পুতিনের সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ যুদ্ধে মোকাবিলা করা যায়। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে রাশিয়ার সেনা মারা পড়েছে ১ হাজার ২শরও বেশি—এ দাবি ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির তরফ থেকে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের হিসাব অনুযায়ী, সেনা মারা পড়েছে ৪০০’র বেশি। রাশিয়ান সামরিক বিমান ভূপাতিত করার কথাও বলা হয়েছে। সেই সংখ্যা চারটি, আর হেলিকপ্টার একটি।
প্রতিরোধ যুদ্ধে জেলেনস্কি বেশিদিন টিকতে পারবেন না- এটা সবাই জানে। তারপরও পশ্চিমারা এই অসমযুদ্ধে নিজেদের জড়াবে না, সেটা অনেক আগেই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জানিয়েছে একই কথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোও। সেটা হয়তো এতোদিন বিশ্বাস করেনি জেলেনস্কি, কিন্তু বাস্তবে যে তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে তা না হলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধেই আছে। আর তার রূপ সীমিত। ওই সীমিত অবরোধ দিয়ে বিশালদেহী রাশিয়াকে কাবু করা কঠিন, যদিও অনেক সংকট আছে পুতিনের সামনে।
সে সব সত্ত্বেও পুতিনের নিজস্ব যে অর্থনৈতিক স্ট্যাটেজি গড়ে তুলেছেন তিনি, তাতে তার আস্থা আছে। রাশিয়ার ৬৩ হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভের মাত্র ১৬ শতাংশ রেখেছেন তিনি ডলারে, ১৩ শতাংশ রেখেছেন চীনা টাকায়। ফলে ডলারের নিয়ন্ত্রকরা তাকে কাবু করতে পারবে না সহজে। আবার সমস্যাও আছে। রাশিয়ান ধনকুবেরা এরই মধ্যে চাপ দিচ্ছে পুতিনকে। কারণ ২০১৪ সালের পর পাঁচটি ব্যাংক ও কয়েকজন ধনকুবেরের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল,তা এখনো বলবৎ আছে। তার ওপর পশ্চিমারা ক্রমে অর্থনৈতিক অবরোধের আকার বড় করছে। সেই আকারের ভেতরে স্বয়ং পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠ সার্কেলের লোকরাই বেশি। তারা এখন পুতিনের সঙ্গে দেখা করে চাপ দিচ্ছে। এতে পুতিনের সমস্যাগুলো আরও বেড়ে যাবে/ যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাতেও আছে তার প্রাকৃতিক জ্বালানি অস্ত্র। ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের ৪০ শতাংশ জ্বালানির (তেল ও গ্যাস) সরবরাহ পায় রাশিয়া থেকে। সবচেয়ে বেশি সরবরাহ পায় জার্মানি। সে তার ১৪ শতাংশ তেল/গ্যাস পায় রাশিয়া থেকে। তার মানে রাশিয়া যদি তেল/গ্যাসের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়, তাহলে জার্মানিই কেবল নয় অনেক দেশই বেকায়দায় পড়বে। ইউরোপের মহানগরগুলোতে চূলা জ্বলবে না। হোটেল রেস্তোরাঁগুলো অচল হয়ে পড়বে। বাড়িতে বাড়িতে জ্বালানি সংকটের কারণে হিটারগুলো চলবে না। শীতে কাবু হবে মানুষ। খাদ্যের জন্যও হাহাকার পড়বে। এটা হচ্ছে সম্ভাব্য চিত্র, যা হতে পারে, যদি…।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। রাশিয়া যদি তেল/গ্যাস সরবরাহ বা রফতানি বন্ধ করে দেয় তাহলে তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঘাটতি শুরু হবে। সেই আর্থিক ঘাটতির মোকাবিলা কতোদিন করতে পারবে রাশিয়া, সে হিসাব আমাদের জানা না থাকলেও, আমরা অনুমান করতে পারি, সেই সংকটের অভিঘাত খুবই স্পর্শকাতর হতে বাধ্য। ব্যাপারটা উভয়পক্ষ থেকে স্পর্শকাতর।
পরস্পরের নির্ভরশীলতা বিষয়টি মনে থাকলে যেমন ইউরোপ সীমিত অর্থনৈতিক অবরোধ বাড়াবে না, তেমনি রাশিয়াও তার রফতানি বাণিজ্যের দুয়ার বন্ধ করবে না। এটাই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু যুদ্ধবাজ চেতনা অনেকটাই লোভের আর নেশার অন্ধকারে বসে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে পছন্দ নয় ভ্লাদিমির পুতিনের, কারণ জেলেনস্কি জাতীয়তাবাদী, মানে ইউক্রেনিয়ান জাতিসত্তার মানুষ। আর পুতিন ইউক্রেন কোনো জাতি নয় তাই তার জাতীয়তাও নেই বলেছেন। তাই তিনি চান তাকে সরাতে। সেই সরানোর কাজটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বদলে সামরিক শক্তির ব্যবহার যে অনৈতিক ও অন্যায়-অপরাধমূলক, তা কি তিনি জানেন না?
যুদ্ধ মানেই মানুষ হত্যার সূচনা। সেই হত্যাযজ্ঞের সূচনা তিনি করেছেন ইউক্রেনের তিনদিক থেকে সৈন্য ঢুকিয়ে দিয়ে, সেই অপরাধের বিচার তো হতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতে। প্রথমত তিনি ২০১৫ সালে মিনস্কে বসে যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এই শর্ত মেনে নিয়ে যে তিনি আর ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা নস্যাৎ করবেন না। তিনি সেই চুক্তির ওপর থেকে নিজের দেওয়া ওয়াদাও তুলে নিয়েছেন। তার মানে তিনি রাজনৈতিকভাবে নিজেকে দেউলিয়া প্রমাণ করলেন। একে তিনি ক্ষতি মনে করছেন না। কারণ তিনি তার সামরিক শক্তির প্রমাণ দেখাতে ব্যস্ত।
পতিত পরাশক্তির অপমানকে তিনি নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত। সেই কাজে তিনি পাশে পেয়েছেন চীনকে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার মিত্রতা ভেঙে গিয়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ থেকে। লেলিনের সঙ্গে মাও জে তুংয়ের রাজনৈতিক মতপার্থক্যই এ দুটি দেশকে রাজনৈতিকভাবে দুই ধারায় বিভক্ত করে। আজও সেই রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত। তবে নতুন চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ভেতর দিয়ে রাশিয়া চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব লাভ করে। এ-দিক থেকে চীন যেমন পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধী তেমনি রাশিয়াও পশ্চিমাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তাই তো শত্রুর শত্রু বন্ধু। চীনের সঙ্গে বন্ধুতার পেছনে এই ইকুয়েশন কাজ করেছে।
২.
পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই চেষ্টা করেছে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকট নিরসন হোক কূটনৈতিকভাবে। অর্থাৎ আলোচনার টেবিলেই এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হোক। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন আলোচনায় বসেছিলেন রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু সেই আলোচনা যে শূন্য ফল দেবে তা তখনই বোঝা গিয়েছিল। তারপরও বার বার রাশিয়াকে এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে ইউক্রেন আক্রান্ত হলে এর জবাব কঠিনভাবে দেওয়া হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই হুঁশিয়ারিকে কঠিন বলে মনে করেনি রাশিয়া বা পুতিন। ওই সময় পুতিন ইউক্রেনের সীমান্তের তিনদিকেই এক লাখেরও বেশি সেনা সদস্য ও ভারী সামরিক অস্ত্র ও যানবাহন জড়ো করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাসাধিককাল আগে থেকেই বলে আসছে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করতেই সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে চলছে।
পশ্চিমা বিশ্ব যতোই বিশ্বাস করুক বা রাশিয়াকে সজাগ করুক না কেন কিংবা সরাসরি হুমকি দিক না কেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা পাত্তা দেননি। তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই ইউক্রেনের রাজধানীর পতন ঘটাতে সেনাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এমন কি তিনি ইউক্রেনের সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেছেস ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করো। মানে তিনি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে উসকে দিয়েছেন ক্ষমতাগ্রহণের জন্য। এটাও যে অপরাধ, সেটা নিশ্চয় তিনি জানেন। অন্য দেশের সেনাবাহিনীকে উসকানি দেওয়া অপরাধের শামিল। এসব সামরিক ও রাজনৈতিক অপরাধের জন্য পুতিনের বিচার হবেই একদিন আন্তর্জাতিক আদালতে।
বোঝা গেলো পুতিন চায় জেলেনস্কির পতন। এবং সে দেশে একটি মস্কো-অনুগত সরকার গঠন করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যই, এই যুদ্ধ বাধিয়েছে। জেলেনস্কির অপরাধ তিনি ও তার সরকার মস্কোপন্থি নয়, তিনি চান পশ্চিমাদের সঙ্গে থাকতে। তিনি চান নর্থ আটলান্টিক সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে। এটাই তার অপরাধ। জেলেনস্কির এই অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দিতে চায় পুতিন এবং তার বাহিনী এখন ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে মস্কোবিরোধীদের হত্যা কিংবা আটক করছে।
কিন্তু ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী সক্ষম যুবকদের হাতে অস্ত্র পৌঁছে যাওয়ায় এবং তারা ইউক্রেনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বলে কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তাদের হাত থেকে কি বিদেশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সহজেই বাঁচতে পারবে? আমাদের মনে হয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, কিয়েভের পাড়া-মহল্লায়ও মস্কাইট বাহিনীর মৃত দেহ মিলবে।
৩.
দোষারোপ সহজ। কিন্তু কোনো বিষয়ে সমাধানে পৌঁছার যোগ্যতাই একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান গুণ। ভ্লাদিমির পুতিনের অনেক গুণ থাকলেও ইউক্রেন প্রশ্নে কেন তিনি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরেননি, তা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। যতোদিন ধরে জো বাইডেন বলেছেন যে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, ততো তিনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু শেষমেশ তো বাইডেনই সঠিক হলেন। পুতিন একজন আক্রমণাত্মক নেতা হিসেবে বর্ণিত হবেন। এমন কোল্ড ব্লাডেড তিনি যে হুমকির মুখেও বলছেন তিনি তার মর্ম উল্টাবেন না।
তবে এখন কিয়েভ দখল হলে তিনি বলবেন আসুন আলোচনায় বসা যাক। কিয়েভের পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার আহ্বান অব্যাহত ছিল। বরং মস্কোর তরফে তাকে নানান টালবাহানা করে সময় খরচ করে চলছিল। খবর পড়ে বোঝা যাচ্ছে মস্কো টেবিলে ফিরতে আগ্রহী। তবে সেই আগ্রহ উত্যুঙ্গে উঠবে কিয়েভের পতনের পর, আমাদের এটাই মনে হয়। তবে হুমকি তো আর বন্ধ থাকে না। পশ্চিমাদের জবাবে পুতিনের জবান খামোশ নয়। পুতিনের ভাষ্য হচ্ছে তিনিও কঠিনতর জবাব দেবেন যে কোনো পশ্চিমা সামরিক তৎপরতার। ফ্রান্স এর উত্তরে বলেছে, পুতিন ভুলে গেছে যে আমরা পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। মানে গোটা ইউরোপই পরমাণুমক্তিধর।
ইসরায়েল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত হতে পারে, খবরে এটাই জানা গেছে। তারা ওই দায়িত্ব দিলে তা পালন করবে। মস্কো দেখাতে চায় গোটা বিশ্বকে- তার নতুন ক্ষমতার রূপ, মানে পরাশক্তি হিসেবে পুনরায় উত্থান। তার নয়া পরাশক্তিসম উত্থান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো সেটা মেনে নিলেই কেবল বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ শুরু হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এমএস