চাঁদপুরের ব্যারাম কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার খনি!
শিক্ষা-গবেষণার চেয়ে চুরি, দুর্নীতি, দলবাজির বেশি লীলাভূমি হয়ে উঠছে সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জমি অধিগ্রহণ, নিয়োগ, কেনাকাটা থেকে শুরু করে স্থাপনা নির্মাণ, টেন্ডার, ভর্তিসহ পরতে পরতে কেবল টাকার গন্ধ। ক্ষমতাসীন বা তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা ভাগে-যোগে এই গন্ধের শরিকানা পেলে আর সমস্যা হয় না। শব্দও হয় না। মিলমিশ-সমঝোতার জয় হয়। ভেজাল বাধে ভাগে না মিললে বা বাদ পড়লে।
প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-চাবিপ্রবি প্রতিষ্ঠা থেকে জমি অধিগ্রহণ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর স্বজনদের অনিয়ম-দুর্নীতির নিষ্পত্তি না হতেই প্রকাশ পেয়েছে পাশ্ববর্তী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর। এটি নতুন বা প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বেশ প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতিতে আর্থিক লেনদেনসহ দুর্নীতি পুরনো খবর। বিভাগীয় কিছু অনিয়মের খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। নির্মাণাধীন ফটকের রড চুরির ঘটনা পর্যন্ত রয়েছে। নিয়মবহির্ভূত অনেক কর্মকাণ্ডও বাসি খবর। নতুন খবর হচ্ছে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নতুন করে জমি অধিগ্রহণেও দুর্নীতি।
এর আগে অভিযোগ ছিল সম্প্রসারণের নামে এটি বিভক্ত করার চেষ্টার। এজন্য বর্তমান ক্যাম্পাস থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রাজারখোলা গ্রামে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার তোড়জোড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিগ্রহণ করার উপযোগী ভূমি থাকার পরও ক্ষমতাসীন একটি গ্রুপের সহযোগিতায় প্রকল্প পাস হওয়ার আগে থেকেই একটি প্রভাবশালী মহল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিক্রির জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে কিনে রেখেছে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম সারওয়ারের ১২ হাজার টাকা বেতনের ড্রাইভার আবদুর রাজ্জাকের নামেই রয়েছে প্রায় ৫০ বিঘা। এই জমি কেনা হয়েছে অধিগ্রহণ প্রকল্প পাস হওয়ার কিছুদিন আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিগ্রহণকৃত জমির এক দলিলেই ৭২ বিঘা জমি রয়েছে চেয়ারম্যানঘনিষ্ঠদের। এ ধরনের ঘটনার নেপথ্য বুঝতে কী বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে?
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের ১১তম সভায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুমোদন দেওয়া এক হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশিরভাগই ব্যয় হবে ভূমি অধিগ্রহণে। প্রকল্পের আওতাধীন ভূমি অধিগ্রহণে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই মৌজার ৭, ৯, ১২ এবং ১৩ নম্বর শিটে অন্তর্ভুক্ত জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ১২ ও ১৩ নম্বর হচ্ছে রাজারখলা গ্রামে, যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। অধিগ্রহণ প্রকল্প পাস হওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘ক্যাম্পাস বিভক্তিকরণের’ অভিযোগ তুলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। কিন্তু ক্ষমতায়-হিম্মতে তারা দুর্বল।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট ক্রমাগত বাজেট বাড়লেও এই টাকা খরচের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও বিহিতের খবর খুব কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের কাছ থেকে দুই ধরনের বাজেট পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রতি বছরের ব্যয় এবং আরেকটি উন্নয়ন বাজেট, যেটি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এক হিসাবে গত ১০ বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সরকারি অনুদান বেড়েছে ৩৬১ শতাংশ। ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য প্রতি বছর ব্যয় হতো প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা।
এছাড়া গত চার-পাঁচ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর বেশিটাই গেছে জাহাঙ্গীরনগর ও কুমিল্লায়। বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে অভ্যন্তরীণ গোলমালের নেপথ্যে অন্যতম কারণ এই টাকার ভাগযোগ। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০০৯ সালে ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম-বেশি অর্ধশত। এগুলোতে জবাবদিহিতার জায়গাটা বড় সংকীর্ণ। এই সুযোগে কেবল অধিগ্রহণ বা কেনাকাটা নয়, গবেষণার টাকা নিয়ে পর্যন্ত নয়-ছয় করতে কারও বুক কাঁপে না। লাজ-শরমের বালাইও নেই। মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কিছু আপত্তি আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টিকে না। চাঁদপুর-কুমিল্লা বলে কথা নয়; উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে দিনে দিনে বিদ্যাপীঠের বদলে কামাই-রোজগারের ভ্যানুতে পরিণত হচ্ছে এর কী লাগাম টানার দরকার নেই?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম