মরণ তোমায় পারবে না কেড়ে নিতে
শোক শুধু মুম্বাইয়ে নামেনি, এই শোক পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের মনে নেমেছে। যারা শোকাহত, তাদের অনেকেই হয়তো প্রিয় মানুষটিকে সামনাসামনি দেখেননি কখনো। হয়তো হাতে হাত রাখার সুযোগ হয়নি, হয়তো চরণ ছুঁয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, তারপরও আজ তাদের মন মেঘাচ্ছন্ন থাকবে, চোখে নামবে বৃষ্টির ধারা। কারণ লতা মঙ্গেশকর আর এই পৃথিবীতে নেই।
মহামারির এই সময়ে বিদায়ের তালিকা আরো একটু লম্বা হলো, তাতে যোগ হলো আরো একটি নাম। ওপারে জমা হলো এপারের প্রিয় একজন মানুষ। কিংবদন্তির এই শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি গান গেয়েছেন ৩৫টিরও বেশি ভারতীয় ভাষায়। গত ৭৩ বছর ধরে তিনি মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছেন তার কণ্ঠ দিয়ে। আমরা তো বটেই আমাদের বাপ-দাদাদেরও প্রিয় শিল্পী ছিলেন তিনি।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই পৃথিবীত আসেন, লতা। শাস্ত্রীয় সংগীত ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ও শেবান্তির ঘরে জন্ম। পারিবারিকভাবে তাঁকে প্রথমে হেমা নামে ডাকা হতো। অভিনেতা বাবার ‘ভাব বন্ধন’ নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে নতুন নাম অর্জন করেন তিনি। সেখানে তিনি লতিকা চরিত্রে অভিনয় করেন। এতেই হেমা হয়ে যায় লতা। আর কালক্রমে মঙ্গেশকর পরিবারের এই মেয়ে নিজের নামকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ট্রাগলকে শুধু কাজে মগ্ন থেকে জয় করার এই অনুপ্রেরণার অপর নাম লতা মঙ্গেশকর। ভারতও তাকে ভারতরত্ন উপাধি দিয়ে সন্মানিত করেছে। তারকা মানে কালো চশমার আড়ালে থাকা নয়। লতা মঙ্গেশকর বিশ্বাস করতেন মাটির সঙ্গে যোগাযোগ থাকা বড় তারকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য তিনি শচীন টেন্ডুলকার ও অমিতাভ বচ্চনের মাঝে খুঁজে পেতেন।
ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকারকে খুব পছন্দ করতেন। শচীনের অপরিসীম শ্রদ্ধা এই সংগীত কিংবদন্তির জন্যে। লতার কণ্ঠকে তিনি ভালোবাসতে শুরু করেন সেই ছোট বেলায়। দেশ -বিদেশে যেখানে যেতেন সঙ্গে থাকে লতার গান। দুই ভুবনের দুই গ্রেট এর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আমাদেরকে উৎসাহ দিয়েছে, মানুষকে ভালোবাসতে।
৯ জানুয়ারি তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। চলে যাওয়ার সময় তার বয়স হলো ৯২। তিনি নেই, তার কণ্ঠ থেকে যাবে আরো অনেক অনেক বছর। হয়তো হাজার বছর। তার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনো। আর সুযোগ নেই। তবে পৃথিবীর মানুষ তার কণ্ঠ শুনতে পাবে আরো অনেক অনেক বছর। এখানেই একজন শিল্পী সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়।
বিষয়টি আরো সহজ করে বলি। কোন একজন বন্ধু আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ তাকে কারণে অকারণে আমরা পাশে পাই। তাকে দেখতে পাই, তিনি সঙ্গ দেন। তার অনুপস্থিতি মানে, তার সঙ্গ নেই। ফলে জীবনে তার বাস্তব উপস্থিতি থাকতে হয়। শিল্পী বাস্তবে আমাদের সঙ্গে থাকেন না। তার গান, কণ্ঠ, প্রতিভা আমাদেরকে সঙ্গ দেয়। কখনো কখনো বিপদ কাটিয়ে উঠার মন্ত্র দেয়, প্রার্থনা করার ভাষা দেয়।
ফলে, শিল্পীর মৃত্যু আমাদেরকে বাস্তব জীবনে লেনদেনের ক্ষতি করে না। কিন্তু মনের প্রয়োজনে, নিজের অগ্রগতির প্রয়োজনে যেসব বিষয় দরকার তার সরবরাহ একজন শিল্পীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন থেকে চলে যায়। ফলে, একজন শিল্পীর প্রস্থান তাই পৃথিবীর জন্য ক্ষতির, এ আমাদের মনের গভীর ক্ষতির কারণ।
যা হোক লেখা শেষ করার আগে যতীন মিশ্রর বই থেকে একটু উদ্ধৃতি দেই। সেখানে লতা বলেছেন, সারা দিনে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েই কেটে যেতো। এমনও দিন গেছে, যেদিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরতো- যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।
এবার বলি কেন এই লাইনগুলো তুলে ধরলাম। এখানে কাজের প্রতি লতার টান দেখুন। গান গাওয়ার মতো কঠিন একটি কাজ নাওয়া খাওয়া ভুলে করে যাওয়া, এই একাগ্রতা, এই পরিশ্রম করার মানসিকতা খুব কী সাধারণ মনে হচ্ছে? এই পরিশ্রম করার মতো মনোবলই একজন মানুষকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। দীর্ঘদিন এই মনেভাব ধরে রাখতে পারলে তিনি গ্রেট হতে পারেন। তার সঙ্গে যদি যোগ করা যায় ভালোবাসা তবে সাফল্য অপ্রতিরোধ্য। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ ভালোবাসার এক পবিত্র রূপ।
যা হোক, মানুষ কতো কম বাঁচে! কচ্ছপকে পরম করুণাময় কতো আয়ু দিয়ে পাঠালেন। মানুষকে আরো কিছু বেশি আয়ু দিলে কতো ভালো হতো। আর কতো বছর পর এমন একজন লতাকে পৃথিবী পাবে তা আমার জানি না। বিদায় লতাজি, বিদায় কিংবদন্তি। আপনার গানের মত করেই বলতে হয়-
ওপারের ডাক যদি আসে
শেষ খেয়া হয় পাড়ি দিতে
মরণ তোমায় কোনদিনও
পারবে না কভু কেড়ে নিতে।
গভীর শ্রদ্ধা রইল আপনার কাজের প্রতি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম