শেষ পর্যন্ত যেন সিনেমার জয় হয়

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২২

একসময় এফিডিসির গেটে দিনভর ভিড় লেগে থাকতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ শুধু এফডিসি দেখার জন্য ঢাকায় আাসতো। এফডিসির সামনে দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে প্রিয় নায়ক-নায়িকাকে একঝলক দেখার তৃপ্তি নিয়ে ফিরে যেতো।

সেই দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। তবে হঠাৎ করেই এফডিসি এবং বাংলাদেশের সিনেমা দেশের সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। যদিও বিষয়টি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত নয়, শিল্পী সমিতির নির্বাচন সম্পর্কিত; তবুও এ আগ্রহ আশাজাগানিয়া।

শুক্রবার দিনটি ছিল অন্যরকম। রাজধানীতে বসেছিল তারার মেলা। আকাশের তারকারা সব মাটিতে নেমে এসেছিলেন যেন। এফডিসিতে বসেছিল চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন আর শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল অভিনয় শিল্পী সংঘের নির্বাচন। তবে সবার সব আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল শিল্পী সমিতির নির্বাচন।

মূলধারার গণমাধ্যম তো বটেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব সয়লাব ছিল শিল্পী সমিতির নির্বাচনের নানা খবরে। রিয়াজের কান্না তো রীতিমতো ভাইরাল। কাঞ্চন-নিপুণ, মিশা-জায়েদ প্যানেল নিয়ে ছিল নানামুখী আলোচনা। নিপুণ চিত্রনায়িকা হিসেবে যতটা না জনপ্রিয়, নির্বাচনের মাঠে তারচেয়ে বেশি।

মাত্র ৪২৮ জন ভোটারের একটি সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের মানুষের এত আগ্রহ একটু বিস্ময়করই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, এই প্রথম শিল্পী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে। আগেও হয়েছে, কিন্তু সে নির্বাচনের খবর কেউ রাখেনি। তাহলে এবার কেন সবাই শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে এমন মেতে উঠলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছি অনেক।

বাংলাদেশের মানুষের রক্তের ভেতর রয়েছে নির্বাচনী উন্মাদনা। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই প্রহসন, একতরফা ফলাফল। অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আমেজ হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়।

শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়; বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও পেশাজীবী সংগঠনেও ইলেকশনের বদলে সিলেকশন হতো। কাঞ্চন-নিপুণের পাল্টা প্যানেল না এলে শিল্পী সমিতিতেও একই ঘটনার, একই নেতৃত্বের পুনরাবৃত্তি হতো। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পেয়ে বাংলাদেশের সচেতন মানুষ ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে ফলো করেছে শিল্পী সমিতির নির্বাচন।

শিল্পী সমিতির সাথে দূরবর্তী কোনো সম্পর্ক নেই, এমন মানুষও রাতভর অপেক্ষা করেছেন ফলাফল জানার জন্য। ভোটার নন, এমন মানুষও এফডিসির বাইরে পরিবর্তনের পক্ষে স্লোগান দিয়েছে। পরিবর্তনের আকাঙক্ষাই শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের মানুষকে আগ্রহী করে তুলেছিল।

পুরো পরিবর্তন না হলেও মিশা সওদাগরকে হারিয়ে সভাপতি হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তবে নিপুণ পারেননি জায়েদ খানের হ্যাটট্রিক জয় ঠেকাতে। ঠেকাতে না পারলে নিপুণ যে ধাক্কাটা দিয়েছেন তাও কম নয়। মাত্র ১৩ ভোটের পরাজয়ের পরও আমি মনে করি নিপুণের নৈতিক জয় হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নিপুণের এ ধাক্কা অনেককে অনুপ্রাণিত করবে।

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির আসলে কাজ কী? বলা হয়, বছরে একটা পিকনিক করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু চাইলে আরও অনেক কাজ করার সুযোগ তাদের আছে। নির্বাচনী প্রচারণায় সবাই অনেক সংযত ছিলেন। কাদা ছোড়াছুড়ি ছিল না বললেই চলে। তবে নির্বাচনের দিন জায়েদ খানের বিরুদ্ধে ভোটারদের নগদ অর্থ দেওয়ার অভিযোগ আনেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী নিপুণ।

আসলেই টাকা দিয়ে ভোট কিনেছেন কি না জানি না। তবে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পীরা এক/দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যাবেন, এটা ভাবতেও লজ্জা হয়। তবে বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। আমাদের কাছে যতই তারকা হোক, কাজ না থাকলে তো তার কোনো আয়ও নেই। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির এমন অনেক সদস্য আছেন যাদের কাছে এক/দুই হাজার টাকাই অনেক।

‘দুস্থ শিল্পী’ একটা বেদনাদায়ক টার্ম আছে। কাজের অভাবে বা কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে অনেক শিল্পীই দুস্থ বনে যান। কিন্তু ‘দুস্থ শিল্পী’ একটি সুস্থ সমাজের জন্য লজ্জার। শিল্পী সমিতির প্রথম কাজ হলো ‘দুস্থ শিল্পী’দের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজকে সুস্থ করে তোলা।

কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করা। এটা ঠিক ইলিয়াস কাঞ্চন আর জায়েদ খান রাতারাতি এফডিসির সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবেন, এমনটা আশা করা ঠিক নয়। তবে সাধারণ মানুষের বিপুল আগ্রহকে পুঁজি করে তারা নতুনভাবে শুরু করতে পারেন।

শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আশা জাগিয়েছে, কারণ এ নির্বাচনের পথ ধরে যদি বাংলাদেশের সিনেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন নিয়ে যত মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছে, সবাই যদি হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন, তাহলে আশাবাদী হওয়াই যায়।

একসময় বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ সবাই হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন। সপরিবারে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার স্মৃতি এখনও অনেককে নস্টালজিক করে। সেই দিন হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এখন মৃতপ্রায়। কিছু বিকল্পধারার সিনেমা নিয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা হয় বটে, কিন্তু এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন হাতে গোনা যায়। নেটফ্লিক্স, ইউটিউব, ওটিটিসহ নানা বিকল্প মাধ্যমের জনপ্রিয়তায় দেশী চলচ্চিত্র প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে না বলে হলের সংখ্যা কমছে। হলের সংখ্যা কমছে বলে সিনেমায় বিনিয়োগও কমছে। এই ধারণা সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সিনেমা দেখে না, এ অভিযোগ সত্যি নয়। বাংলাদেশের যত মানুষ পয়সা দিয়ে নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রাইব করে, তারা হলে গেলেও সিনেমা বেঁচে যেতে পারে।

পাশের দেশ ভারতের কোনো কোনো সিনেমা এখনও শত কোটি টাকার ব্যবসা করে। কোনো কোনো ইংরেজি সিনেমার জন্য বাংলাদেশের সিনেপ্লেক্সে ভোর রাত থেকে লাইন ধরে নতুন প্রজন্ম। তাই মানুষ সিনেমা দেখে না বা হলে যায় না; এ অভিযোগ করে লাভ নেই। আসল সমস্যা হলো, আমরা মানুষের দেখার মতো সিনেমা বানাতে পারি না। আর উন্মুক্ত বিশ্বে সবকিছু এখন সবার হাতের মুঠোয়। তাই নকল করলেও সাথে সাথে সেটা ধরা পড়ে যায়।

তাই চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচাতে হলে ভালো সিনেমা বানাতে হবে। মানতেই হবে কাজটা অনেক কঠিন। বাংলাদেশের মানুষেরও চোখ খুলে গেছে। চাইলেই তারা বিশ্বের সেরা সব সিনেমা দেখতে পারে। তাই তাদের হলে ফেরাতে হলে শুধু ভালো নয়, অনেক ভালো এবং মৌলিক সিনেমা বানাতে হবে।

আমি জানি, শুধু শিল্পী সমিতির পক্ষে এটা সম্ভব নয়। অনেক ভালো সিনেমা বানাতে অনেক ভালো প্রযোজক লাগবে, অনেক ভালো কাহিনি লাগবে, অনেক ভালো পরিচালক লাগবে। তবে শিল্পী সমিতি তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ-উচ্ছ্বাসটাকে ধরে রেখে চলচ্চিত্র শিল্পে একটা নবজাগরণের চেষ্টা করতে পারে। নিজেদের সীমানার বাইরে গিয়েও তারা সবাইকে উজ্জীবিত করতে পারে। তারা ভালো কাজ করলে অবশ্যই মানুষ তাদের পাশে থাকবে। শিল্পী সমিতির নির্বাচনের জয় নয়, শেষ পর্যন্ত জয় হোক চলচ্চিত্র শিল্পের।

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

শিল্পী সমিতি তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ-উচ্ছ্বাসটাকে ধরে রেখে চলচ্চিত্র শিল্পে একটা নবজাগরণের চেষ্টা করতে পারে। নিজেদের সীমানার বাইরে গিয়েও তারা সবাইকে উজ্জীবিত করতে পারে। তারা ভালো কাজ করলে অবশ্যই মানুষ তাদের পাশে থাকবে। শিল্পী সমিতির নির্বাচনের জয় নয়, শেষ পর্যন্ত জয় হোক চলচ্চিত্র শিল্পের।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।