ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট: একটি উপলব্ধি
যুগ যুগের অপেক্ষা শেষে ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সিলেট ফ্লাইট শুরু হয়েছিল মহামারির আগে। এমনিতেই ম্যানচেস্টার বিমানের বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ভালো। বাণিজ্যিক সফলতা আছে এ রুটের। আছে মুনাফা বানানোর সার্থকতা। কিন্তু তারপরও ম্যানচেস্টার থেকে সরাসরি ফ্লাইট উড্ডয়নের ব্যাপারে বিশেষত কতিপয় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরোধিতা ছিল। এরই একজন যিনি আমার সামনে প্রকাশ্যেই বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেচস্টার ফ্লাইট চালুর বিরোধিতা করেছেন একটা গণমাধ্যমে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ম্যানচেস্টারের ওই ট্রাভেল ব্যবসায়ী বিমানের এজেন্ট হয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন এ ব্যবসায়। অধুনা তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ট্রাভেল ব্যবসার ঝাঁপি বন্ধ করলেও বিমানের এজেন্ট হিসেবে টিকিট বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে। লন্ডনের কিছু ব্যবসায়ীও এরকম চরম বিরোধিতা করেছেন ম্যানচেস্টার-বাংলাদেশ ফ্লাইটের।
বিমানে ভ্রমণ নিয়ে কিছু আলোচনা-সমালোচনা আছে। যখন ম্যানচেস্টার থেকে বিমানের ফ্লাইট চালুর জন্য ক্যাম্পেইন চলছে বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে, কমিউনিটির বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা বিভিন্নভাবে ঢাকায় বিমানের পরিচালক কিংবা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে দাবি উত্থাপন করছেন, তখনও তারা এ বিরোধিতায় থেমে থাকেননি। সুখের কথা হলো, বিমানের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করায় শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট চালু হয় মহামারি শুরু হওয়ার আগে।
কিন্তু মহামারিতে নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে বিমানকেও বসে থাকতে হয়। পৃথিবী সচল হলে বিমান কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট চালু করে আবারও। গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ম্যানচেস্টার-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট। সেদিন থেকেই যাত্রী ভর্তি বিমান নিয়ে চলছে ম্যানচেস্টার-সিলেট-ম্যানচেস্টার ফ্লাইটের দুটো ফ্লাইট।
মহামারিতে দেশে যেতে না পারা মানুষগুলো নিজে দেশের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। তাই টিকিটের চাহিদা এতই বেড়েছে যে, দ্বিগুণ ভাড়ায় মানুষ যাত্রী হচ্ছে বিমানের। এবং আগামী প্রায় দুই মাসের ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইটে আসন পাওয়া যাচ্ছে না। জুন-জুলাইয়ে অর্থাৎ ছুটির মৌসুমে টিকিটের দাম এখনই সহনীয় পর্যায়ের উপরে চলে গেছে। এতে বিমান ব্যবসায়িক দিক থেকে এ মহামারিকালীন লোকসান কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবে বলে ধারণা করা যায়।
এখানে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে ভ্রমণকারী মানুষের সংখ্যা কীভাবে বেড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অন্যান্য এয়ারলাইন্সের টিকিটের মূল্য দেখলে। সাধারণত কাতার, ইত্তেহাদ ও আমিরাত এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম থাকে আনুপাতিক হারে কম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুধু ঢাকা পর্যন্ত এই এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দেড়গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। ব্যবসায়ীরা বলেন, সাধারণত আসন যখন দ্রুত বিক্রি হতে থাকে, অর্থাৎ যখন টিকিট বিক্রির চাহিদা বাড়ে, তখন মূল্যবৃদ্ধি হতে থাকে।
ম্যানচেস্টারে বিমানের সাফল্যের কারণে অনেকেই মনে করেন, বিমানের ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে, যা এর আগে একজন বিমানের পদস্থ কর্মকর্তা আমাকেও ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন ম্যানচেস্টার থেকে আরেকটা ফ্লাইট তাদের ভাবনায় আছে। ম্যানচেস্টার থেকে বিমানের ফ্লাইট নিরবচ্ছিন্ন হোক এটা নর্থ ওয়েস্ট ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড বার্মিংহামসহ এ অঞ্চলের বাংলাদেশী কমিউনিটি আশা করে, কিন্তু ব্যস্ত সময় ছাড়া তিনটা ফ্লাইট কি চলমান রাখা যাবে, তা ভাবনায় নিতে হবে। কারণ মহামারি উতরে গেলে এরকম ব্যস্ততা নাও থাকতে পারে, তখন তিনটা ফ্লাইট চালু থাকলে ব্যবসায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। তখন লোকসান দেখিয়ে একটা ফ্লাইট বন্ধ করা যাবে ঠিকই, কিন্তু অতীতের ইতিহাস বলে লোকসান দেখিয়ে সব ফ্লাইটই বন্ধ করা হয়েছে।
আমরা বিমানের আরও ফ্লাইট আশা করতেই পারি। এখন সংকটকালীন যাত্রীসেবা বাড়াতে এবং বিমানের টিকিটের আরও বিক্রয় বৃদ্ধি করতে এটা করা যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে চাহিদা বিবেচনা করে তিনটা ফ্লাইট আদৌ কি প্রয়োজন- এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এরকমই একটা ফ্লাইটের ইকোনমি আসনের একটি আসনের যাত্রী হয়েছিলাম গত ২১ জানুয়ারি, যা শুনেছিলাম, তাই। কানায় কানায় পূর্ণ। যদিও আমার পরিচিত একজন আসতে পারেননি। কারণ পিসিআর টেস্টে আগের দিন তার পজিটিভ হয়। এরকমই হয়তো আরও দু-একটা আসন খালি ছিল।
ম্যানচেস্টার থেকে বিমান উড্ডয়নে নির্ধারিত সময় থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট দেরি হয়। দেরিতে যাত্রা করায় বিমানের ব্যাখ্যা আমরা শুনিনি। তবে আমরা জেনেছি, কুয়াশার কারণে কিছুটা দেরি করে ফ্লাইট ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু তবুও যাত্রীদের খুব একটা হা-হুতাশ করতে দেখা যায়নি।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিমান উড্ডয়ন করে। আসনগুলো সামান্য সংকীর্ণ হলেও দেশ-যাত্রা মানুষদের এই ঘণ্টা দশেকের সামান্য কষ্ট ভুলিয়ে রাখে, দীর্ঘ যাত্রাপথে বিশেষত বয়স্ক যাত্রীরা মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করলেও কিছুটা না দেখারই ভান করে ফ্লাইটের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
যাত্রীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে দেখা যায়নি, যাত্রীদের সাথে শুধু একবার বাগবিতণ্ডা করতে দেখা গেছে শুল্কমুক্ত সিগারেট বিক্রিকালীন। কারণ চাহিদা অনুযায়ী সিগারেটের সরবরাহ ছিল অল্প। যদিও বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে উত্তেজিত একজন কর্মকর্তার উচ্চালাপ বেমানান ঠেকেছে। তিনি নিজে থেকে খুব জোরেশোরেই তার নাম বললেন, এ-ও বললেন, ‘আমার ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারেন, আমি ২৭ বছর থেকে এখানে কর্মরত।’
মনে হলো যেভাবেই হোক খুঁটির জোরটা একটু মজবুতই বটে। আমার কাছে কিছুটা বিস্ময়ই লেগেছে, যাত্রীদের সচেতনতার কারণেই বিমানের টয়লেট এই দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জার্নিতেও দুর্গন্ধে ভরে ওঠেনি কিংবা নোংরা হয়নি, পানিতে ভিজে ভিজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠেনি। সত্যি কথা হলো, খুব একটা অভিযোগ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের সামান্য পরে বিমান সিলেটে অবতরণ করে।
মহামারির আগে দেশে আসার সময়ও দেখেছি, বিমানবন্দরে মোটামুটি একটা গোছালো অবস্থা। এবার দেখলাম, ইমিগ্রেশন পাড়ি দিতে বেগ পেতে হয়নি। তবে কেন জানি পিসিআর টেস্ট নেগেটিভ, ‘কোভিড পাস’ সার্টিফিকেট থাকার পরও বিমানবন্দরে ঢোকার পর কোভিড টেস্ট করা হলো।
প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম, এটাই নিয়ম। পরে দেখি অনেকেই এই টেস্ট ছাড়াই বেরিয়ে এলেন। জানা গেলো না এর কারণ। বেল্টের কাছাকাছি রাখা লাগেজ বহনের ট্রলির সংখ্যা অল্প নয়। লাগেজ টানাটানিতে নিয়োজিত কর্মকর্তারা শালীনভাবেই যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশ চাইছেন। তবে এ বকশিশের পরিমাণটা তারা একটু বেশিই চেয়ে বসেন।
যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা একটা লাগেজের শুধু সন্ধান দিতে ১০ পাউন্ডের বকশিশ চাওয়া কিছুটা বেমানানই লেগেছে। তবে বাইরে এসে কিছু টাকা নিতে তারা অসম্মতি জানান নিরাপত্তাকর্মীদের ভয়ে। অন্যদিকে বিমানবন্দর পাড়ি দেওয়ার পর অহেতুক দু-একজনের অযাচিতভাবে লাগেজ স্পর্শ করে অর্থ চাওয়ার ব্যাপারটা নিরাপত্তা কর্মীদের দেখা উচিত।
তবুও বলতেই হয়, মোটামুটি ঝামেলামুক্ত ছিল ম্যানচেস্টার-সিলেট ফ্লাইট। দেশযাত্রা কিংবা দেশফেরত সময়গুলো যাত্রীদের ভালো কাটা মানেই তো ‘আকাশে শান্তির নীড়।’
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস