পৃথিবীর ফুসফুস ২২ ভাগ নিঃশেষ মানুষের কত?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

পৃথিবীর ফুসফুসের ২২ ভাগ ক্ষয়ে গেছে। করোনায় নয়। ভয়ানক আগুনে ভস্মীভূত হয়ে। দাবানলের দাউ দাউ করা আগুন পৃথিবীর ফুসফুসরূপে খ্যাত আমাজনের ঘন জঙ্গল ও লম্বা গাছগুলো অঙ্গার হয়ে গেছে। আদিবাসী মানুষ গুলোর লতাপাতা দিয়ে তৈরি বসতবাড়িগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বার বার আগুন লাগছে এদিকে ওদিকে। বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে ৩৮গুণ বড় আমাজন বন। গত একবছরে আমাজনের ২২ ভাগ উজাড় হয়ে গেছে। এই বন নিধন হওয়া অঞ্চল ১৭টি নিউইয়র্ক শহরের সমান বড় বলে জানা গেছে।

পৃথিবীতে যত অক্সিজেন আছে তার বিশভাগই যেহেতু উৎপাদিত হয় আমাজন বনের গাছপালা থেকে সেজন্য তাকে পৃথিবীর ফুসফুস বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আমাজন নদীর অববাহিকায় ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, গায়ানা, পেরু, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশের মধ্যে বিস্তৃত এই বৃহৎ বনকে ‘সেলভা অরণ্য’ বা মায়াবনও বলা হয়ে থাকে। আমাজন চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি চিরসবুজ গাছপালা ও জঙ্গল এবং এর অনেক এলাকা রেইন ফরেস্ট হওযায় পৃথিবীকে প্রাকৃতিক শ্বসনে সব সময় তাজা রাখতে এর আলাদা কদর রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু বৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নয়। বিভিন্ন দেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়া এই ধরিত্রী খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। লু-হাওয়া, খরা, ভ্যাপসা গরম, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী. ধূলিঝড় সারাবছর লেগেই আছে কোন না কোন অঞ্চলে।

গহীন বনাঞ্চলে শুকনো গাছে বাতাসের ধাক্কায় ঘর্ষণ লেগে আগুন লেগে পুড়ে যাচ্ছে গাছ। সঙ্গে ছাই করে দিচ্ছে বসতবাড়ি, নগর, জনপদ সবকিছু। দাবানলের আগুন নেভাতে তৎপর দমকল কর্মীরা বাতাসের প্রবল চাপে আগুনের লেলিহান শিখা বেড়ে গেলে নিরুপায় হয়ে পড়ছেন।

কানাডা, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ কোথায় নেই দাবানল? বিমান, হেলিকপ্টার দিয়ে ড্রাই কার্বন, পানি ছিটানো কোন কিছুতেই কাজ হয়নি। অনেক দেশের গহীন বনাঞ্চলের দাবানলের আগুনের কাছে এসব প্রতিকার ব্যবস্থা যেন নস্যি মাত্র।

প্রাকৃতিক দাবানল প্রাকৃতিক কারণে ঘটে থাকে। গহীন বনে শুকনো গাছের ডালে ডালে ঘর্ষণের ফলে আগুন ধরে যায়। তবে ভেজা গাছের মধ্যে ঘর্ষণেও আগুন লাগে আবার বজ্রপাতের ফলেও হঠাৎ আগুন লেগে দাবানলের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট দাবানল এখন একটি নতুন অনুষঙ্গ তৈরি করছে। কিছুদিন পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বনের আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক ব্যক্তির হঠকারিতার কথা জানা গেছে। সে একাই গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বনে গিয়ে দেশলাইয়ের আগুন থেকে শুকনো পাতার মাধ্যমে বনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই আগুন ভয়ংকর দাবানলের সৃষ্টি করেছিল।

কপ-২৬ সম্মেলন কী দিল? দাবানল নিয়ন্ত্রণে কিছু ভেবেছে?

উন্নত বিশ্বের মানুষের গাড়ি ছাড়া একদিনও চলে না। গ্রীষ্মে তারা বাসায় ও কর্মস্থলে একদণ্ড এসি ছাড়া থাকে না। শীতে জ্বালায় ফায়ারপ্লেস ও হিটার। বিশ্বব্যাপী মাংসের উৎপাদনের জন্য গরু, ঘোড়া, ভেড়া, মুরগির জন্য ব্যয় করা হয় অর্ধেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কাঠ। এগুলো ছাড়াও তাদের কার্বণ নির্গমন করার প্রধান উৎস গাড়ি। গাড়ির কারখানায় গাড়ি নির্মাণ কখনও বন্ধ নেই। তাহলে কার্বণ নিঃসরণ বন্ধ হবে কীভাবে?

কপ-২৬ সম্মেলনে কেউ এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। এ ধরনের অনেক সম্মেলন আগেও বহুবার হয়েছে। কিন্তু কার্বণ নিঃসরণ কমেনি বরং আরো বেশি বাড়ানোর পাঁয়তারা করেই যাচ্ছে ধনী দেশগুলো। শিল্পজাত কৃত্রিম পণ্য, গাড়ি, যন্ত্রপাতি বিক্রি, মাংস, দুধ রপ্তানি যাদের আয়ের প্রদান উৎস।

আফ্রিকাসহ পানির সংকট বহু দেশে। ঠান্ডা আবহাওয়ার দেশের মানুষেরা পানির বদলে টিস্যু পেপার ব্যবহার করে সারা বছর। খাবার টেবিল থেকে টয়লেট সব জায়গায় পেপারের তৈরি দ্রব্য আজকাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ওয়ান টাইম থালা-বাটি, গ্লাস, প্যাকেট সবকিছুই কাগজের। এগুলো পরিবেশকে প্লাস্টিকের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা মাত্র। কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে গাছের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ব্যাপক হারে গাছ কর্তন করা হচ্ছে।

বনের গাছ, জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড়, নদী- ডোবা-পুকুরের কচুরি পানা, সমুদ্রের শৈবাল, প্লাঙ্কটন সবকিছই দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আগাছা নিধনের নামে বিষ স্প্রে করে মেরে ফেলা হচ্ছে ঘাসপালা, বনজ ঔষধি গাছ। গবাদি পশুর চারণভূমি কমে গিয়ে ওদের খাদ্যাভাব শুরু হয়েছে। কীট-পতঙ্গ মরে গিয়ে পাখির খাবারও ধ্বংস করে ফেলছি আমরা প্রতিনিয়ত।

পৃথিবীটা আক্রান্ত হয়েছে বিষাক্ত কেমিক্যালের ব্যাপক ব্যবহারের থাবায়। বিশেষ করে করোনকালে স্যানিটাইজারের অতি ব্যাবহার চোখে পড়ার মত ছিল। ওগুলোর অতি ব্যবহারে কত ক্ষতি তার ওপর গবেষণা করার ফুরসৎ কোথায়? আগে তো শুধু ভাত খাওয়ার পূর্বে হাত ধোয়া হতো। করোনাকালে দিনে ১০-১২ বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে জীবন বাঁচানোর কথাই বলা হচ্ছে।

টয়লেট পেপার পৃথিবীর মাত্র ১৬ ভাগ মানুষ ব্যবহার করে। তাতেই গাছ ও ঘাসের ত্রাহি অবস্থা। যদি ৫০-৬০ ভাগ মানুষ পানি ছেড়ে টয়লেটে শুধু টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে শুরু করে তাহলে কি হবে? পৃথিবীতে গাছ বা ঘাস কি থাকবে? এক গবেষণায় দেখা গেছে যদি পৃথিবীর সকল মানুষ শুধু জাপানিজদের মত টিস্যু ও টয়লেট পেপার ব্যবহার শুরু করে তাহলে পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর সব গাছপালা উধাও হয়ে যাবে।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে পুকুর-নদী ভরাট করা হচ্ছে। নদীতে বাঁধ দেয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয় শুকিয়ে গেছে। তাই কচুরিপানাও নেই যে টয়লেট পেপার তৈরির কাঁচামাল বিনা পয়সায় যোগাড় করা যাবে।

শস্যদানার খড়, বিচালী গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেগুলো টিস্যু পেপার তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু হলে গরু-ঘোড়া-ভেড়ারা খাবে কি? ভুট্টার গাছই যদি না থাকে তাহলে মুরগি ও মাছের ফিড তৈরি হবে কি দিয়ে?

দূষিত বাতাসের কারণে দিল্লীতে লকডাউন দেয়া হয়েছে। ওদের বাতাসে ধুলোর পরিমাণ কার্বনের চেয়ে বেশি। আর আমাদের বাতাসে কার্বন ও ধুলো দুটোই বেশি। সারাবছর নির্মাণ কাজ চলে আমাদের দেশে। খানা-খন্দকে রাস্তায় হাঁটা যায় না। একটু বৃষ্টি হলেই গাড়িও পানিতে সাঁতার কাটে শহরগুলোর রাজপথে।

করোনার তৃতীয় ঢেউ আবারো হানা দিয়েছে। মানুষ মাস্কটাও পরতে চাচ্ছে না। ইউরোপের জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্সে পুনরায় লকডাউন দেয়া হয়েছে। অষ্ট্রিয়ায় একটানা বিশ দিনের লকডাউন অমান্য করে মানুষ রাস্তায় নেমে পুলিশের সাথে মারামারি করছে। নেদারল্যান্ডন্সে লকডাউন বিরোধীরা ক্ষুব্ধ হয়ে স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে প্রতিবাদ করেছে।

করোনার দীর্ঘ প্রভাব মানুষকে করেছে অসহিষ্ণু। স্বাস্থ্য, জলবায়ুর ক্ষতি ইত্যাদি নিয়ে তারা বেশি কিছু ভাবতে চায় না। ভাল কিছু করতেও চায় না। সবাই যেন স্বার্থপর হয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচতে তৎপর।

এভাবে গোটা পৃথিবীর প্রাকৃতিক আবরণ, আভরণ, আস্তরণ সবকিছুই গিলে চুষে খেয়ে মানুষ শুধু নিজের জীবন বাঁচাতে চায়। পৃথিবীর ফুসফুস জ্বলে যাচ্ছে দাবানলে আর মানুষের ফুসফুস অকেজো হয়ে যাচ্ছে করোনার করাল আক্রমণে প্রয়েজনীয় অক্সিজেনের অভাবে।

বিষয় দুটি গভীরভাবে ভেবে দেখার মত। কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই শশব্যস্ত হয়ে যাওয়া ই-মানুষদের। ই-মানুষরা তাদের ই-ব্যবসা শুরু করে প্রতারণার জাল দিয়ে পৃথিবীকে বেঁধে ফেলে বড় বেকায়দা সৃষ্টি করে ফেলেছে। ফলে পৃথিবীর ২২ ভাগ ফুসফুস আজ নষ্ট, বাকিটা ক্ষয়িষ্ণু। পাশাপাশি বার বার করোনার ফিরে আসার আতঙ্কে মানুষের ফুসফুস ও অস্তিত্ব উভয়ই চরম হুমকির মুখে নিপতিত হয়ে এক অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে সবাই।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

করোনার দীর্ঘ প্রভাব মানুষকে করেছে অসহিষ্ণু। স্বাস্থ্য, জলবায়ুর ক্ষতি ইত্যাদি নিয়ে তারা বেশি কিছু ভাবতে চায় না। ভাল কিছু করতেও চায় না। সবাই যেন স্বার্থপর হয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচতে তৎপর।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।