কেন মর্যাদার নোংরা তলানিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা?
মহামারি করোনার কারণে টানা দুই বছর বন্ধের পর খুলতে না খুলতেই নতুন করে পুরোনো নোংরামি শুরু হয়েছে দেশের শিক্ষাঙ্গনে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। খুলনা প্রকৌশলের পর এখন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট সৌন্দর্যঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তালা ঝুলছে। অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল শাবিপ্রবি। ভিসিকে খেদানোর গো ধরেছে তারা। অথচ ভিসি সাবজেক্ট ছিলেন না।
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের চোখ রাঙানির কঠিন সময়ে এসে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমালটা বেঁধেছিল বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজাকে নিয়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কেটে পড়েছেন, মানে পদত্যাগ করেছেন তিনি। সেখানে নতুন প্রভোস্ট করা হয়েছে অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে।
এর আগে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় সংগঠন ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খলতার জেরে প্রাণ গেছে একজন শিক্ষকের। এরই জেরে সেখানেও তালা ঝুলছে। এরপর আবার খুলেছে। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত নানা কেলেঙ্কারি ও অপ্রীতিকর ঘটনা তো রয়েছেই।
শাহজালালে খিল পড়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কাউর পাকানো হয়েছে একেবারে হাতে ধরে। ভিসি প্রফেসর ফরিদ উদ্দীন আহমেদ ও প্রশাসনের একগুঁয়েমির জেরটা পড়েছে নোংরা রূপে। ভিসিকে সেখানে অবাঞ্ছিত করেছে শিক্ষার্থীরা। তাকে পদত্যাগ করিয়ে ছাড়ার আন্দোলনে বন্ধ ক্যাম্পাস উত্তাল। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে একটি ভবনে লুকিয়ে-অবরুদ্ধ হয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তিনি।
জান বাঁচলেও ইজ্জত বেঁচেছে কি না-সেই বোধের অবকাশই রাখছেন না কোনো কোনো ভিসি এবং শিক্ষক। পুলিশ তাকে সেখান থেকে মুক্ত করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। প্রয়োগ হয় রাবার বুলেট-সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিপেটা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-পুলিশ মিলিয়ে আহত অন্তত ৫০।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা নিজেরাই নিজেদের ধাওয়া বা শিক্ষার্থীদের হাতে মার খাওয়ার জায়গায় নিয়ে গেছেন। দেশের শিক্ষাখাতের প্রধান সম্পদ এবং গর্বের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন এ দুর্দশা? কেন এমন দুর্গতি ফরিদ উদ্দীনদের? ভাবেন তারা?
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রভোস্ট-সহকারী প্রভোস্টের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত না হোক অন্তত আশ্বাস পেলেও ঘটনা এতোদূর গড়াত না। ভিসি সাবজেক্ট ছিলেন না। মোটামুটি মন্দের ভালো হলেও পার করে নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটনার পরিণামে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফরিদউদ্দীনের অতীত-বর্তমান মেলানো পোস্টমর্টেম শুরু হয়েছে। নইলে এর কোনো শঙ্কাই ছিল না।
বিএনপি আমলে বিএনপিপন্থি সাদা দল করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের সবার সঙ্গে ভাঁজ দিয়ে চলার একটা ক্যারিশমা আছে। এক সময় সাদা দল করতেন। বর্তমান সরকার আমলে বঙ্গবন্ধু চেয়ার আবিষ্কারের মতো বিএনপি আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়া চেয়ার করার চেষ্টা ছিল তার। কিন্তু তখন বিষয়টিকে আচানক ভেবে এগোয়নি বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামীপন্থি নীল দলে ভিড়ে দ্রুত নিজের অবস্থা পোক্ত করে নেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হন। সেখান থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি।
ডক্টরেট না থাকলেও গার্মেন্টস ব্যবসা আছে। তাতে সমস্যা হয়নি। বরং সম্ভাবনার দুয়ার আরও খুলেছে। দ্বিতীয়বার নিয়োগও পেয়েছেন। একা তাকে দোষী সাব্যস্ত করলে তা হবে অবিচার। তিনি এই জমানার ভিসিদের প্রতীক মাত্র। বাদবাকি অনেকের গুণ-মানের দশা প্রায় এমনই।
দলবাজির বরকতে যেনতেন একটি কলেজের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিরাও বিশ্বিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। প্রভোস্ট, ডিন, প্রক্টর, বিভাগীয় চেয়ারম্যান এমনকি ভিসিও হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসির চেয়ারম্যান, সদস্যসহ আরও কতো কী হচ্ছেন। নাম খোদাই করে নিচ্ছেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীদের কাতারে। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করার জের কতো দিন টানতে হবে, কে জানে?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এএসএম