ওমিক্রন: শাঁখের করাত

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
প্রকাশিত: ০১:৪৩ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

ওমিক্রন নিয়ে আমাদের অবস্থা এখন অনেকটা শাঁখের করাতের মতন। এই লেখাটি যখন লিখতে বসা, তখন বাংলাদেশে একদিনে নতুন কোভিড রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশ ছাপিয়ে গেছে। দুনিয়াজুড়েই একের পর এক রেকর্ড ভেঙে চলছে ওমিক্রন। ডেল্টার তাণ্ডবেও যেখানে একদিনে গোটা পৃথিবীতে নতুন রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে কি ছাড়ায়নি, সেখানে এক মার্কিন মুলুকেই একদিনে ১০ লাখের বেশি মানুষকে কোভিডে কুপোকাত হতে দেখেছি আমরা এই কদিন আগেই।

ওমিক্রন নিয়ে দু’ধরনের বিষয় আলোচনায় আসছে। বলা হচ্ছে এটি আপাতদৃষ্টিতে ডেল্টার চেয়ে কম বিধ্বংসী হলেও একটু অসচেতনতায় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। কারণ ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে ঢের বেশি তাড়াতাড়ি ছড়ায়। কাজেই একসাথে অনেক মানুষ একদিনে ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে তাতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়তে বাধ্য।

ডেল্টার সময় আমরা দেশে দেশে আইসিইউ আর শশ্মান-গোরস্থানে যে মিছিল দেখেছি সে জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে ওমিক্রনের জোয়ারেও। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা দলে দলে আক্রান্ত হয়ে পড়লে একেতো রোগীর চাপ আর অন্যদিকে সেবা দেয়ার জনবল সংকটে ভেঙে পড়তেই পারে স্বাস্থ্যসেবা।

এমনটি আমরা রিয়েল টাইমেই হতে দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মতো উন্নততম দেশগুলোতেও, যেখানে সামান্য কোভিড টেস্ট করতেই লেগে যাচ্ছে তিন-চারদিন আর হাসপাতালে শয্যার অভাবে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে দিনের পর দিন হুইল চেয়ারে বসিয়ে।

আবার এই ওমিক্রন নিয়েই শোনানো হচ্ছে আশার বাণীও। বলা হচ্ছে, ওমিক্রনের মধ্যে দিয়েই হয়তো শেষ হবে কোভিড মহামারি। এরপর রোগটি প্যান্ডেমিক থেকে হয়তো অ্যান্ডেমিকে পরিণত হবে। অর্থাৎ কোথাও কোথাও কিছু কিছু মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হবেন ঠিকই, কিন্তু দুনিয়াজুড়ে সবাই এক সাথে, একভাবে আর বিপদগ্রস্ত হবেন না।

এমনটি বলার কারণ, অতীতেও দেখা গেছে প্রথম ওয়েভের পর প্যান্ডেমিকের দ্বিতীয় ওয়েভটি সাধারণত আরও ভয়াবহভাবে আসে, কিন্তু তারপর তৃতীয় ওয়েভে এর সংক্রমণের হার কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও, ভিরুলেন্স বা রোগ সৃষ্টির সক্ষমতা কমে আসে। এর কারণ অনেকগুলো।

ভাইরাসের বারবার মিউটেশনের কারণে যেমন এরকমটি ঘটতে পারে, তেমনি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে হার্ড ইমিউনিটিরও। তাছাড়া এবারই একটি প্যান্ডেমিক চলাকালীনই আমরা একাধিক কার্যকর ভ্যাকসিন পেয়ে গেছি, যেখানে স্প্যানিশ ফ্লুর ভ্যাকসিনের জন্য মানব জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্যান্ডেমিকটি শেষ হওয়ার পরও আরও তিন দশকের বেশি সময়। এই কথাগুলোই উঠে আসছে বিশেষজ্ঞদের লেখায় আর বলায় আর এমনকি খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শীর্ষ কর্তার বক্তব্যেও।

তবে কোভিডকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানানোর এই যে অসম্ভব সুযোগটি আমাদের সামনে উপস্থিত তাকে কাজে লাগাতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ ভাইরাস যদি বিনা বাধায় একজন থেকে আরেকজনে আর আরেকজন থেকে আরও অনেকজনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, সেক্ষেত্রে তার আরও কোনো মিউটেশন হয়ে যাওয়ার শঙ্কাটা থেকেই যায়। সেক্ষেত্রে ওমিক্রন যেমন ডেল্টাকে হটিয়ে বিশ্ব জয় করছে, তেমনি ডেল্টার চেয়েও খারাপ কোনো ভ্যারিয়েন্টকে যে ওমিক্রনের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

অথচ এবারই কেন যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা মানুষের উদাসীনতা বড্ড বেশি। আগেও আমরা দেখেছি অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে চান না। কিন্তু এবার এই না মানার দল অনেক ভারী। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ আছে অনেক। চেষ্টা আছে মানুষকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর আর প্রয়োজনে বাধ্য করারও। আমার নিজস্ব কয়েকটা অবজারভেশন আছে এ বিষয়ে।

প্রথমতঃ ওমিক্রন নামটাতেই সমস্যা আছে। এ নামটা এমনভাবে চাউর হয়েছে যেন পৃথিবী থেকে কোভিড বিদায় নিয়েছে আর তার জায়গায় এসেছে ওমিক্রন নামে নতুন কোনো প্যান্ডেমিক। সমস্যা আছে আরেকটা জায়গায়ও। আমরা ডেল্টার সাথে বারবার তুলনা করতে গিয়ে মানুষকে একটা ভুল সিগন্যাল দিয়ে বসেছি যে ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে অনেক কম মারাত্মক।

অথচ এটি যে ডেল্টার মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সেটি আমরা সেভাবে মানুষকে বোঝাতে পারিনি। তার চেয়েও বড় বিষয়, আমরা বেমালুম ভুলে গেছি যে ওমিক্রন আসলে কোভিডেরই একটি ভ্যারিয়েন্ট। যে সময় ডেল্টা ছিল না তখনও কোভিডে লাখ লাখ মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

পাশাপাশি রোগ নিয়ে আমাদের যে চিরায়ত ধারণা, অর্থাৎ আমাকে আমার রোগের চিকিৎসা করাতে হবে আমার ভালোর জন্য, আমরা সেই জায়গাটা থেকে কোনো মতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমার লক্ষণ নেই, তারপরও আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নিতে হবে আপনার ভালোর জন্য- এ বিষয়টা আমরা এখনও ঠিকঠাক মতো আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি। আমার মনে হয় সামনে যখন আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করবো তখন আমরা এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে পারি।

গতকালও আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষকর্তা সাবধান করে বলেছেন ওমিক্রনে পরিণতিটা ভয়াবহ হতে পারে। শুধু এই একটি কারণই যথেষ্ট খুব দ্রুত সচেতন হওয়ার জন্য আর তার উপর তো থাকছে সচেতন হয়ে কোভিডকে পাকাপাকি বিদায় জানানোর সুযোগটাও। অতএব আসুন সচেতন হই, ভ্যাকসিন নেই আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে আপনি-আমি-আমরা সবাই মিলে ভালো থাকি।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক

আমাকে আমার রোগের চিকিৎসা করাতে হবে আমার ভালোর জন্য, আমরা সেই জায়গাটা থেকে কোন মতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমার লক্ষণ নেই, তারপরও আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নিতে হবে আপনার ভালোর জন্য- এই বিষয়টা আমরা এখনও ঠিকঠাক মত আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি। আমার মনে হয় সামনে যখন আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করবো তখন আমরা এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে পারি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।