নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু ভোটেই আইভীর জয়
আমাদের দেশে একেক সময় একেকটি কথা চালু করে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চালু হওয়া কথাটি হলো, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে আওয়ামী লীগ জিতবে না। আওয়ামী লীগ না জিতলে কোন দল জিতবে এবং কেন জিতবে সে প্রশ্ন করা হলে অবশ্য সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায় না। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এই বাণী আওয়ামী লীগবিরোধী মহল থেকেই ছড়ানো হয় এবং এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যাতে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরাও বিভ্রান্ত হন কখনো কখনো। সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও এমন কথা ছড়ানো হয়েছিল যে, সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী হারবেন।
এই কথাটি আমার একজন সাংবাদিক বন্ধুও বললেন এবং জানালেন যে, কোনো একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টকশোতেও বলেছেন। আমি একটু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, আইভী না জিতলে কি তৈমূর আলম খন্দকার জিতবেন? তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, তৈমূরের অবস্থা ভালো।
আমি জানতে চাই, যার সঙ্গে তার নিজের দল নেই, যার সঙ্গে সরকার নেই, নির্বাচনে জেতার অভিজ্ঞতাও যার নেই, তাকে মানুষ ভোট দেবে কোন আশায়?
বন্ধু খুশি হলেন না হয়তো। তাই প্রসঙ্গ পালটে বললেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা তো ভালো করতে পারেনি। আমি বলি, যেখানে প্রার্থী মনোনয়নে ভুল হয়েছে, জনপ্রিয় প্রার্থী বাদ দিয়ে টাকা খেয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সেখানে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে তা হয়নি। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ যোগ্য ব্যক্তিকেই নৌকা দেওয়া হয়েছে। আইভী জনপ্রিয়, পরীক্ষিত এবং অভিজ্ঞ। তার পরাজয় হলে আমাদের অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটের দিন পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। কোনো ধরনের মারামারি, হানাহানি হয়নি। সারাদেশে অনেকের মধ্যেই ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। ভোটাররা নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন। কেউ কারো ওপর কোনো প্রভাব খাটাননি, বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়নি, বাধ্য করা হয়নি।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে যা বোঝায় নারায়ণগঞ্জে তাই হয়েছে। বিরোধী দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালনকারী নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বলেছেন, ‘এ নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। বিগত ৫ বছরে যতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, আমার বিবেচনায় আমাদের প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বোত্তম’। ‘সর্বোত্তম’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন। যারা প্রচার করেছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন সুষ্ঠু নির্বাচনে আইভী জিতবে না, তারা এখন কি বলবেন?
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’, ‘বিনা ভোটে', ‘একতরফা ভোটে’, ‘আগের রাতের ভোটে’ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যে প্রবণতা চলছে, সেখানে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। নারায়ণগঞ্জে প্রমাণ হয়েছে যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাই চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়।
সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৬৬ ভোট। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মাসুম বিল্লাহ পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৮৭, খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন ১০ হাজার ৭২৪, কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস ১ হাজার ৯২৭, খেলাফত আন্দোলনের মো. জসিমউদদীন ১ হাজার ৩০৯ এবং স্বতন্ত্র প্রাথী কামরুল ইসলাম ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছেন।
সব প্রার্থীর ভোট মিলিয়েও আইভীর প্রাপ্ত ভোট বেশি। তবে আইভী লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভের যে আশা করেছিলেন, সেটা পূরণ হয়নি। এর বড় কারণ এবার ভোট পড়েছে আগের দুই নির্বাচনের চেয়ে কম। এবার ৫০ শতাংশের মতো ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারও লক্ষাধিক ভোটে জেতার আশা করেছিলেন। ফলাফল ঘোষণার পর তিনি বলেছেন, ইভিএম কারচুপিতে তাঁর পরাজয় হয়েছে বলে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘জনগণ আমাকে নির্বাচনে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ইভিএমে কারচুপির জন্য আমার পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয়কে আমি পরাজয় মনে করি না।
জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভেতরেও একটা ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। নইলে এত ব্যবধান হতে পারে না’। অর্থাৎ অভিযোগ মূলত পরাজয় নিয়ে নয়, ভোটের ‘ব্যবধান’ নিয়ে। তবে তিনি ইভিএমে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এটা পরাজিত হলে অভিযোগ করার যে সংস্কৃতি দেশে চালু হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। ইভিএমে ভোট গ্রহণে কিছুটা ধীরগতি ছিল, কেউ কেউ অপেক্ষা করে ভোট না দিয়ে হয়তো চলেও গেছেন কিন্তু ইভিএমে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং করে একজনের ভোট অন্য জনকে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটা বুয়েটের একজন শিক্ষক আমাকে বলেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটির নির্বাচনের ফলাফল থেকে আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে। সরকার বা নির্বাচন কমিশন চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হবে বলে যারা মনে করেন তারা একটি ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাদের কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ ভোটাররা না চাইলে নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখা সহজ হয় না। নারায়ণগঞ্জে সব পক্ষই একটি বিতর্কমুক্ত ভালো নির্বাচন চেয়েছেন, তাই নির্বাচনটি শেষপর্যন্ত ভালো হয়েছে।
নির্বাচন এলে তাড়াহুড়ো করে মাঠের অবস্থা বিবেচনা না করে নানাবিধ সংকীর্ণ বিবেচনা থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় অনেক সময় সমস্যা হয়। এমন প্রার্থী ভোটের মাঠে উপস্থিত করা উচিত নয়, যাকে নিয়ে বিতর্ক আছে, সমালোচনা আছে। মানুষের ওপর প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হলে অনেক সময় মার্কার জোরে তাকে জিতিয়ে আনা কঠিন হয়।
সবগুলো বড় দলেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন প্রকট। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে এই সমস্যা বেশি। ক্ষমতাসীন দল থেকে মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে জেতা সহজ- এই ধারণা থেকে অনেকেই এখন ভোটে দাঁড়াতে চান। নিজের পরিবারের সদস্যরাও যাকে ভোট দেবেন কিনা সেটা নিশ্চিত না হয়েও প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যাদের টাকা আছে, তারা মোটা অংকের টাকা ব্যয় করেও কখনো কখনো দলীয় মনোনয়ন কেনেন। এতে ভোট হয়ে যায় টাকার খেলা।
রাজনীতিটা এখন বড় ধরনের লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে বড় বিনিয়োগও ঝুঁকিমুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। তাই রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে। সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এখন ব্যবসায়ী। আরও অনেক জায়গার মতো নারায়ণগঞ্জে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে গভীর সংকট আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে আইভীর বিরোধ অনেক পুরনো। তবে আইভীর ব্যক্তিগত সততার ইমেজ এতটাই উজ্জ্বল যে শামীম ওসমান চেষ্টা করেও তাকে মলিন করতে পারেন না।
এবার নির্বাচনে আইভীর সামনে অহেতুক শামীম ওসমানকে হাজির করে বিতর্ক তৈরির উদ্দেশ্যমূলক অপতৎপরতা থাকলেও আইভীর দৃঢ়তার কারণে তা কোনো জটিলতা তৈরি করতে পারেনি। আইভী পেরেছেন শামীম ওসমানকে রুখতে। অন্য জায়গায় এটা সম্ভব হয় না বলেই ফলাফলে বিপর্যয় দেখা যায়। আওয়ামী লীগকে এই বিষয়টি ভাবতে হবে। দলে থেকে যারা দলবিরোধী ভূমিকা পালন করছে, দলকে সমালেচিত করছে, এমন কি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকেও যাদের জন্য সময়ে সময়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়, তাদের দল থেকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত কঠিন হলেও নিতে হবে।
নারায়ণগঞ্জে আইভী সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জিতেছেন। সবার পক্ষে এমনটা সম্ভব হবে না। আইভীর মতো নেতার সংখ্যা দলে বেশি নেই। এমন কারো হাতে নৌকা তুলে দেওয়া ঠিক হবে না, যার কাছে নৌকা হেফাজতে থাকবে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম