নির্বাচনে ভোটারের চাওয়া পাওয়ার হিসাব কে রাখে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

আগামীকাল নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন। এবং এই নির্বাচন হচ্ছে ইভিএমের সাহায্যে। নির্বাচনের জয় পরাজয়ের পর কেউ গণতন্ত্রের জয় দেখবেন কেউ বা দেখবেন পরাজয়। কিন্তু নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যারা– সেই ভোটার, অর্থাৎ মানুষ তাদের চাওয়া পাওয়ার চেয়ে বড় হয়ে আলোচনায় ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগের কোন্দল।

স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান আর মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর গরম কথাবার্তা ভোটারদের এই নির্বাচনের সব চাওয়া পাওয়ার আলোচনা থেকে দূরে রেখেছে পুরো সময়টায়। একটা স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয়দের চাহিদা নিয়ে উদাসীন থেকেছে রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ এমনকি গণমাধ্যমও।

এই সিটি করপোরেশন বিগত দিনগুলোতে কতটা সেবা দিতে পেরেছে, কত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়েছে, কতটা হয়নি, নতুন কী করা যায়, আগামী দিনের চাহিদা কী, নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমনৎ– এমন বিষয়গুলো উচ্চারিত হয়নি। নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্রিয় ও সরব নাগরিক সমাজও দেখলাম না আমরা এবার।

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে বামপন্থিরা কোন অবস্থানে আছে সেটাও পরিষ্কার হলো না এখন পর্যন্ত। রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে যারা আসেন তারা অনেক ঝুঁকি নিয়েই আসেন, যেমন এসেছেন তৈমূর আলম খন্দকার। এসে দল থেকে পদচ্যুত হয়েছেন। তবে তার দলের নারায়ণগঞ্জ অংশ তার সাথেই আছে, লন্ডন থেকে যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন। সেই বিশ্লেষণটাও অনুপস্থিত ছিল পুরো সময়।

পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, এমন বিষয়গুলোর গুরুত্ব জনজীবনে অপরিসীম। অথচ সেগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেল। নির্বাচনকে ব্যবহার করে জনসমর্থন আদায় একটি জরুরি কাজ, কিন্তু সে জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজ।

জয় পরাজয় আর ভোটের সংখ্যা দিয়ে এর মূল্য নির্ণয় হয় না। জয়-পরাজয়ের মধ্যবর্তী এই জমি তৈরির কাজটি যে গণতন্ত্রেরই কাজ, আমরা নাগরিকরা আজ পর্যন্ত সে জায়গায় কেন অবস্থান সৃষ্টি করতে পারলাম না। আমরা ঘুরি, সময়, শ্রম আর অর্থ বিনিয়োগ করে থাকি ব্যক্তির পেছনে।

জাতীয় কিংবা স্থানীয়, দেশে নিয়মিত নিয়মিত নির্বাচন হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাকে যথেষ্ট গুরুত্বও দেয়, যদিও আজকাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফসল ঘরে তুলবার এক নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। প্রার্থীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যান, প্রচুর অর্থব্যয় করেন। আর উন্নয়নের গল্প বলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর কতজন জনগণের জন্য ভালো কাজ করেন, সেটা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়।

কোন নেতা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত সেটা মানুষ জানেন, কোন নেতা কতটা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সেটাও তারা অবগত। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার জো নেই। নেতারাও জানেন, ভালো কাজের দরকার নেই, বরং দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু মুখ ম্যানেজ করে চলতে পারলে মনোনয়ন নিশ্চিত এবং এলাকায় উন্নয়নের নামে নিজের পকেটও পরিপূর্ণ। আর দরকার ধর্ম বা অন্য কিছু ইস্যুতে সময়মতো উসকে দেওয়ায় পারদর্শী হওয়া।

আগামীকাল নির্বাচন হয়ে যাবে। তবে জয় পরাজয়ের পর ভোটারদের আর খোঁজ মিলবে না। মেয়র প্রার্থীরা কে কত ভোট পেয়েছেন সে হিসাব হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে মানুষের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে যে কাউন্সিলররা, তাদের ট্র্যাক রেকর্ড মূল্যায়ন করা যে বেশি জরুরি সেটারও খোঁজ মিলল না এবার। কার ভাই কাউন্সিল নির্বাচন করে, সে কারাগার থেকে কাকে হুমকি-ধমকি দেয় এমন একটা খবর সামান্য আলোচিত হয়েছিল অবশ্য।

উন্নয়ন কাজ, উন্নয়ন প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উন্নয়নের সব তথ্য মানুষ জানে না, মানুষকে জানানোও হয় না। কোন প্রকল্প কত দিন শুরু হয়ে, কত খরচে শেষ হলো সেটা এক প্রকার অস্বচ্ছই থেকে যায়। একটা বিষয় আমাদের নেতৃত্ব বুঝতে চায় না যে, উন্নয়নের কাজ কে ভালো করছেন, কে কোন খাতে খরচ করছেন, তার হিসাব পেলে গণতন্ত্রের কার্যক্রমে মানুষের আগ্রহ জন্মায়। তাতে ভোটদাতারা রাজনীতির সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হন। নাগরিকের সতর্কতা যত বাড়ে, গণতন্ত্র তত ফলপ্রসূ হয়।

পাঁচ লাখেরও বেশি ভোটার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। তবে এ শহরের বাসিন্দা প্রায় ২০ লাখ। আর বাণিজ্য নগরী হওয়ায় ভোর থেকে গভীর রাত অবধি এ শহরে যাওয়া–আসা করে আরও কয়েকগুণ মানুষ। এমন একটা শহরের যানজট, এ শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গ্যাস ও বিদ্যুতের আয়োজন নিয়ে তো আলোচনা হলোই না, হলো না শহরের সাংস্কৃতিক ও চিত্তবিনোদনের পরিবেশ নিয়েও।

করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্ক অবস্থার মধ্যে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধিকে শিকেয় তুলে মিছিল আর সমাবেশ করে প্রচারণা চলেছে এই নির্বাচনে। কেন মিছিল আর সমাবেশ না করেও মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন না নেতারা সেই উত্তরও আমরা পাইনি ডিজিটাল স্লোগানের এই দেশে।

দলীয় প্রতীকে হোক বা না হোক, এলাকার মানুষের মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রার্থীদের তালিকা তৈরি হতে পারে কি না সেরকম একটা প্রচেষ্টা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচনে কাম্য। মানুষের জন্য কাজ আর সুস্থ নির্বাচনী রাজনীতি– দুটোই গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ।

এইচআর/এমএস

জয় পরাজয়ের পর ভোটারদের আর খোঁজ মিলবে না। মেয়র প্রার্থীরা কে কত ভোট পেয়েছেন সে হিসাব হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে মানুষের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে যে কাউন্সিলররা, তাদের ট্র্যাক রেকর্ড মূল্যায়ন করা যে বেশি জরুরি সেটারও খোঁজ মিলল না এবার।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।