বাংলার দুর্গতি: জানুয়ারিতেই ফেব্রুয়ারির আগাম কান্না
বাংলার প্রতি আবেগ-অনুভূতি, শ্রদ্ধা নিয়ে সচরাচর লেখাজোখা-টক শোসহ কথাবার্তা জমে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। কিছুটা মৌসুমি ঘটনার মতো এতে মাতৃভাষার সম্মান-উন্নয়ন কামনা হয়। জানানো হয় বানান, ব্যাকরণ, উচ্চারণ মিলিয়ে ভুল বাংলা পরিহারের আহ্বান।
দিনকে দিন সেই আহ্বানের আর জায়গা থাকছে না। সম্মানের চেয়ে বাংলা রক্ষাই জরুরি হয়ে উঠছে। অবিরাম ব্যভিচারে বাংলার এখন গুরুচরণ দশা। কেবল জনে জনে নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় মাড়িয়ে এ ব্যভিচারের ধুম দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। অথচ বানান-বাক্য, ব্যাকরণ মিলিয়ে বাংলা ভাষার শুদ্ধতার প্রশ্নে তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। বাংলার বিষয়ে এবারের নতুন বছরে এক চিঠিতে ১৩টি বানান ভুল উপহার দিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনি পারভীন। তিনি আবার বিভাগীয় প্রধানও।
তার চিঠিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেই ভুল। ‘রোকেয়া’ বানান লেখা হয়েছে ‘রোকেযা’। বাদবাকি অবস্থাও করুণ। ‘রেজিস্ট্রার’ বানানে ‘রেজিষ্ট্রার’, ‘দায়িত্ব’ বানানে ‘দাযিত্ব’, ‘বহির্ভূত’ বানানে ‘বহিভূত’, ‘কর্তৃপক্ষ’ বানানে ‘কতৃপক্ষ’, ‘বাতিল’ বানানে ‘বাতলি’। এখানেই শেষ নয়, ‘বাধিত’-কে লেখা হয়েছে ‘বার্ধিত’। ‘গ্রহণ’ বানানে ‘গ্রহন’, ‘আইনি’ বানানে ‘আইনী’ ডিন বানানে ‘ডীন’। এছাড়া ‘বিভাগকে’ ও ‘শিক্ষককে’ শব্দ দুটি লিখেছেন ‘বিভাগ কে’ ও ‘শিক্ষক কে’।
একসঙ্গে এতো বানান ভুল করা যা-তা ব্যাপার নয়। কীভাবে সম্ভব হলো এতো ভুল করা? না কি তিনি বা তারা ভুল-শুদ্ধই জানেন না? এর আগে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসনের মাত্র ৮ লাইনের একটি বিজ্ঞপ্তিতে অন্তত ২২টি ভুল বানানও দেখতে হয়েছে। পরে যাবতীয় দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বেচারা অফিস সহকারীর ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে ভুল বিরল কোনো ঘটনা নয়। বিভিন্ন সময় এনিয়ে গণমাধ্যমে রসালো শিরোনাম হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল থেকে ৯৬টি বিভাগ/ইনস্টিটিউটকে ওয়েবসাইট আধুনিকীকরণ প্রসঙ্গে দেয়া চিঠিটির অগুনতি ভুলও হাসির ধুম ফেলেছে। সেলের পরিচালক একজন ডক্টর এবং অধ্যাপক রহমত উল্লাহ আইন অনুষদের ডিনও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যও। তার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির বাংলা-ইংরেজি দুই ভার্সনেই ভুলের ছড়াছড়ি। বাংলা অংশে অন্তত ৬ এবং ইংরেজি অংশে ৪ মিলিয়ে ১০টি গুরুতর ভুল মোটামুটি পড়াশোনা জানা ব্যক্তিদেরও রীতিমতো ঘোরে ফেলেছে। বিজ্ঞপ্তিটির বাংলা অংশের দ্বিতীয় লাইনে লেখা হয়েছে─ ‘সকল ইনস্টিটিউটসমূহের।’ তৃতীয় লাইনে একইভাবে লেখা হয়েছে ‘সকল কেন্দ্রসমূহ।’ বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে- এই শব্দগুচ্ছে বাহুল্যদোষ হয়েছে। যেখানে বহুবচনবাচক শব্দ ‘সকল’ আছে সেখানে বহুবচন নির্দেশক ‘সমূহ’ লেখা বাহুল্যদোষ। ওই দুই ভুলের শুদ্ধরূপ হবে ‘সকল ইনস্টিটিউট’ অথবা ‘ইনস্টিটিউটগুলোর। আর তৃতীয় লাইনের ভুলের শুদ্ধরূপ হবে ‘সকল কেন্দ্র’কে অথবা ‘কেন্দ্রসমূহকে বা কেন্দ্রগুলোকে।’
তৃতীয় লাইনে লেখা ‘উৎযাপন’-এর সঠিকরূপ ‘উদযাপন।‘ সর্বশেষ ভুল বিজ্ঞপ্তির পঞ্চম লাইনে লেখা ‘বিষয় গুলির’। এটির শুদ্ধরূপ হবে বিষয়গুলির। কারণ বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে বহুবচন-জ্ঞাপক-গুলি/-গুলো/-রা/-এরা/-গণ/-বৃন্দ/-সমূহ- এগুলোর কোনোটাই আলাদা হয় না। তা আগের শব্দের সাথে যুক্ত থাকবে।
বিজ্ঞপ্তির ইংরেজি অংশে চারটি ভুল লেখা হয়েছে। সেগুলো হলো Department institutes Short History এখানে institutes শব্দের শেষে অ্যাপসট্রফি চিহ্ন হবে। একইভাবে লেখা হয়েছে Teachers profile এখানে Teachers শব্দের শেষে অ্যাপসট্রফি চিহ্ন হবে।
এই বিজ্ঞপ্তির ইংরেজি অংশের বাম সাইডের শেষ শব্দগুচ্ছে লেখা হয়েছে Regulation for degree তার আগের শব্দ Publications in pdf form হওয়ায় নিচের শব্দে সামন্তরিকভাবে Regulations for degree হবে। ইংরেজি অংশের আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে Extra curriculum activities এখানে curriculum নয় curricular হবে।
অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ ভুলের দায় নেননি। বলেছেন, তার যে স্বাক্ষরে বিজ্ঞপ্তিটি গেছে সেটা ইলেকট্রনিক সিগনেচার ছিল। দেশের নামকরা আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সনদপত্রেই বিভাগ, হল, শিক্ষার্থীর নামেও ভুলের নানা কাণ্ড ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের এ ধরনের ভুল শেষ পর্যন্ত তেমন ভুল হিসেবে ধরা হয় না। হেয়ালিভাবেই এগুলো পাস কাটিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুজিববর্ষকে মুজিবর্ষ লিখেও পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। যদিও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি মানার নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তবে এখনো প্রশাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। সরকারি আদেশ সংবলিত বা চিঠি-প্রজ্ঞাপন-নোটিশে অহরহই থাকছে ভুল বানান, ভুল বাক্যগঠন।
এছাড়া, সাধু-চলিতরীতির মিশ্রণ তো ব্যাপারই নয়। মাঝে মধ্যে শিক্ষাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের এমন সব চিঠিতে নজর পড়ে নিজে নিজে কষ্ট পাওয়া ছাড়া যেন করার আর কিছু থাকে না। আদবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুয়েক জায়গায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে উল্টো নাক সিঁটকানো বা তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা নিজেকে লজ্জিতই করে।
এমনিতেই আমাদের সব কিছুতে সীমিত-সীমিত ভাব। সময় এবং জীবনও সীমিত। বাংলা নিয়ে এ ধরনের কষ্টের কথা তাই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির আগে জানুয়ারিতেই প্রকাশের ইচ্ছা সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম