দুর্নীতি দমন কমিশনে যাওয়ার পর...

মোকাম্মেল হোসেন
মোকাম্মেল হোসেন মোকাম্মেল হোসেন , সাংবাদিক, রম্যলেখক
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১

অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর সেতুর কাজ শুরু হওয়ার ঘোষণা এলো। এলাকার লোকজন বেজায় খুশি। তাদের এতদিনের স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হতে চলেছে। কিন্তু কাজ শুরুর পর এলাকাবাসী ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এ কী কারবার! হওয়ার কথা কী, আর হচ্ছে কী? এ তো লাউ গাছে লাউ না ধরে জাম্বুরা ধরার মতো ঘটনা। তখন সবাই গিয়ে জব্বার সাহেবকে ধরল। জব্বার সাহেবের বয়স আশির কাছাকাছি। সব শুনে জব্বার সাহেব বললেন,
: এর একটা বিহিত অবশ্যই করতে হবে। দেশে কি নিয়ম-কানুন কিছু নাই নাকি! মগের মুল্লুক হয়ে গেছে এই দেশ? ইত্যাদি-ইত্যাদি।
এ সময় কেউ কেউ বলল,
: আপনি ডাইরেক্ট আমাদের এমপি সাবের কাছে চলে যান।
জব্বার সাহেব মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বললেন,
: উহু, ওখানে গেলে লাভ হবে না। ডিজিটাল-দৃষ্টি লাভ করায় আমাদের এমপি মহোদয়ের চোখে এখন আর দুর্নীতির কোন ঘটনা ধরা পড়ছে না। কাজেই খামাখা তার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
লোকজন তখন জানতে চাইল,
: আপনি তাহলে কোথায় যেতে চান?
: আমি সোজা চলে যাব দুর্নীতি দমন কমিশনে।
গ্রামবাসী জব্বার সাহেবের বুদ্ধির তারিফ করে বলল,
: ঠিক, ঠিক। এরকম ঠাটাপড়া দুর্নীতির বিহিত একমাত্র তারাই করতে পারবে।
জব্বার সাহেব পরদিনই দুর্নীতি দমন কমিশনের দফতরে চলে এলেন। পিএসের শরণাপন্ন হতেই সে বলল,
: আপনি বসুন। স্যার লাঞ্চ করছেন।

খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নেয়ার পর পিএস সেই চিরকুট দুদক চেয়ারম্যানের হাতে দিল। সাক্ষাৎপ্রার্থীরা সাধারণত তাদের পাঠানো চিরকুটে নাম, পেশা, পদবি ইত্যাদি উল্লেখ করে থাকে। কিন্তু এ ভদ্রলোক তার কোন পরিচয় না দিয়ে শুধু নাম ও বয়স উল্লেখ করেছেন। চেয়ারম্যান সাহেব চমৎকৃত হলেন। সাক্ষাৎপ্রার্থী কি চিরকুটে তার বয়স উল্লেখ করে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন- তিনি মুরুব্বি শ্রেণির লোক; তাকে অধিকক্ষণ বসিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।

চেয়ারম্যান সাহেব ভদ্রলোককে সাক্ষাৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। চা খেতে খেতে বুড়া মিয়ার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। অনুমতি পাওয়ার পর জব্বার সাহেব চেয়ারম্যান মহোদয়ের কক্ষে প্রবেশ করলেন। সালাম দিয়ে আদবের সঙ্গে বললেন,
: স্যার, আমি আপনার বেশি টাইম নেব না।
: না, না; ঠিক আছে। আপনি বসুন।
জব্বার সাহেব বসলেন। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
: বলুন...
জব্বার সাহেব ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে বললেন,
: স্যার, হওয়ার কথা সেতু। কিনতু এখন সেখানে সেতু নির্মাণ না করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে।
জব্বার সাহেবের কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব হু বলে মাথা ঝাঁকালেন। তারপর বললেন,
: তবু তো কিছু একটা হচ্ছে! অনেক জায়গায় এমনও নজির আছে, পুরো সেতুটাই হজম হয়ে যাচ্ছে। আপনারা ভাগ্যবান, কলা না পেলেও কলাগাছের থোড়টা অন্তত পাচ্ছেন।
: আমরা থোড়-মোড় চাই না। কলা চাই।
: আপনি কি লিখিত কোন অভিযোগ নিয়ে এসেছেন?
: না।
: একটা লিখিত অভিযোগ দেন। আপনি তো মাত্র ছয় হাত একটা সেতুর সমস্যা নিয়ে এসেছেন। আমাকে বর্তমানে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। কাজেই...
: তাহলে কি আমাদের বিষয়টার কোন সুরাহা হবে না?
: হবে না, তা তো বলিনি। আপনার জালে একটা কাতলা মাছ ও একটা পুঁটি মাছ আটকা পড়লে আপনি প্রথম কোনটার দিকে নজর দিবেন?
: বড়টার দিকেই নজর দেব।
: বর্তমানে আমার অবস্থাও সেরকম। আপনি মুরুব্বি মানুষ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার বিষয়টা অবশ্যই আমি দেখব। বড় ঝামেলাটা আগে শেষ করি...
: কী ঝামেলা স্যার! সেখানেও কি সেতু না করে কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে?
জব্বার সাহেবের কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,
: সেতু-কালভার্টের মামলা না।
: তাহলে কি কোনো ভবন? আরে আল্লাহ!সিমেন্টের বস্তা খোলার আগেই দুই নম্বরি শুরু হয়ে গেছে! ঘটনাটা কি স্যার?
: ঘটনা টাকা পাচার। লোকজন বস্তায় বস্তায় টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে।
: এটা তো সাংঘাতিক ঘটনা, বিশাল ব্যাপার।
: হ্যাঁ, ব্যাপার বিশাল। ঘটনাও অনেক বড়। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। দুদক মাঠে নেমে গেছে। যত বড় দুর্নীতির ঘটনাই হোক, পদ্মার ঢেউয়ের সঙ্গে সব ভাসিয়ে দেব।
(গানের সুরে) পদ্মার ঢেউ রে...
যত অনিয়ম-দুর্নীতি আছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাও, যাও রে...; কী বুঝলেন?
: বুঝলাম, সব ভেসে যাবে।
: ভেসে যাওয়ার বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝতে চাইলে আজ রাতে টেলিভিশনে আমার একটা টক শো আছে, সেটা দেখবেন। সেখানে আমি ভাসিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
: কিন্তু স্যার, টক শো তো টক!
: সমস্যা কী? কিছু কিছু টক আছে, স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। যেমন টক দই। তাছাড়া টকজাতীয় ফলমূলে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিন সি-র গুরুত্ব কতটা, তা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে।
: বুঝতে পেরেছি স্যার।
: তাহলে ধরে নিচ্ছি, অনুষ্ঠানটা আপনি দেখছেন?
: অবশ্যই দেখব স্যার।
: ধন্যবাদ।
বিদায় নেওয়ার আগে চেয়ারম্যান সাহেব করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত ধরা অবস্থায়ই জব্বার সাহেব তাকে বললেন,
: স্যার, কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।
: করুন।
: আপনি একজন জ্ঞানী-গুণী-শিক্ষিত মানুষ; অথচ হাতে লম্বা লম্বা নখ রেখেছেন। কোনো মানত আছে নাকি স্যার?
উত্তর দেওয়ার আগে চেয়ারম্যান সাহেব লম্বা দম নিলেন। তারপর বললেন,
: মানত-টানত কিছু না। অনেকেই দুদককে দন্ত-নখহীন প্রতিষ্ঠান বলে থাকে। দুদক যে আদতে দন্ত-নখহীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, সেটা বুঝানোর জন্যই নখগুলো বড় রেখেছি।

লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক ।
[email protected]

এইচআর/জিকএস

আপনি একজন জ্ঞানী-গুণী-শিক্ষিত মানুষ; অথচ হাতে লম্বা লম্বা নখ রেখেছেন। কোনো মানত আছে নাকি স্যার? উত্তর দেওয়ার আগে চেয়ারম্যান সাহেব লম্বা দম নিলেন। তারপর বললেন, :মানত-টানত কিছু না। অনেকেই দুদককে দন্ত-নখহীন প্রতিষ্ঠান বলে থাকে। দুদক যে আদতে দন্ত-নখহীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, সেটা বুঝানোর জন্যই নখগুলো বড় রেখেছি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।