বাংলাদেশ: আজ তার ৫০ বছর পূর্তি

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তখন ভারত সফরে ছিলেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি। হিন্দু মৌলবাদী শ্যামা প্রসাদ তখন নেহরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ থেকে সব হিন্দু ভারতে নিয়ে ভারত থেকে সমপরিমাণ মুসলমান পূর্ব বাংলায় পাঠানোর জন্য। জবাবে নেহরু তাকে বলেছিলেন পাকিস্তানের দুই অংশের যে ভৌগোলিক দূরত্ব তার কারণে দেশটি ১৫/১৬ বছরের মধ্যে ভেঙে যাবে। অর্থনৈতিক কারণে বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তান তখন ভারতের সঙ্গে যোগদান করবে।

পাকিস্তান ভেঙেছে। সময় নিয়েছে ২৪ বছর। পূর্ব পাকিস্তান রক্তাক্ত সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছে। অভ্যুদয় হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বাংলাদেশ আজ ঠিক ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। কিন্তু নেহরুর পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভারতের প্রদেশ হয়নি। বরং বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান ভারতের চেয়ে উন্নত। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অগ্রগামী।

এই পথ পাড়ি দিতে বাংলাদেশকে কম ঝড় ঝঞ্ঝা সইতে হয়নি। সেই কাহিনী বলার আগে জানাতে চাই ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সময় পূর্ব বাংলা ভারতের সঙ্গে না গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান হলো কেন আর দু’যুগের মাথায় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন কেন হলো বা পাকিস্তানে থাকতে পারলো না কেন? পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের জন্ম হয় ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহাবাগে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বেঙ্গল ছিল পাকিস্তানের একমাত্র অঞ্চল যেখানে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ দেশ সৃষ্টির পর এই অঞ্চলের মানুষ জনসংখ্যায় বেশি হয়েও রাষ্ট্রে সমান প্রতিনিধিত্ব পায়নি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই রাষ্ট্রের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মৃত্যু হয়। ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকেও সামরিকচক্র রাওয়ালপিন্ডির জনসভায় গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকিস্তান সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গিয়েছিল আমলা এবং সেনাবাহিনীর হাতে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন কায়েম করে জেনারেল আইয়ূব খান রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন।

আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তান বৈষম্যের শিকার।। আইয়ুবের সময়ে এ বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিনব্যাপী এক যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিলো। ভারত ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারতো। যুদ্ধের পরেই পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা সচেতন হয়ে উঠেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগই তখন থেকেই মুখর হয়ে উঠেছিলো। অবশেষে শেখ মুজিব ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন, যা ছিল মূলত বিচ্ছিন্ন হওয়ার রূপরেখা।

পাকিস্তানিরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিতে চাইলো। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। দেশের মানুষ বিশ্বাস করলো না বরং মামলাটা শেখ মুজিবের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি বয়ে আনলো। আর স্বাধীনতার পথকে যুক্তিসংগত পরিণতির দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দিল। বিশৃঙ্খলার মাঝে আইয়ুব খান বিদায় নিলেন। আর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। তিনি ক্ষমতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মোতাবেক এক ইউনিট ভেঙ্গে দিলেন আর জনসংখ্যানুপাতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের দাবিও মেনে নিলেন।

লিগ্যাল ফ্রেইম ওয়ার্কস এর দ্বারা নির্বাচন হল। জনসংখ্যা বেশি থাকার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা ছিলো ১৬৪ আর পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদে আসন ছিল ১৩৬, আগে যেখানে ছিল দুই অংশের ১৫০ করে ৩০০ আসন। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৬২ আসন পেয়ে পাকিস্তানের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। পশ্চিম পাকিস্তানীরা শেখ মুজিবের বিজয় দেখে প্রমাদ গুনলেন এবং ষড়যন্ত্র আরম্ভ করলেন। পরিণতিতে ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের বিজয়।

রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার নামে পাকিস্তান তার বাঙালি নাগরিকদের বিরুদ্ধে চরম হত্যা নির্যাতনের পথ নিয়েও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। ৩০ লাখ বাঙালিকে শহীদ হতে হয়েছে, তিন লক্ষ মা বোন ধর্ষিত হয়েছে পাকিস্তানি জান্তাদের দ্বারা।

১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটিকে ‘ভারতের চক্রান্তের শিকার’ বলে দেশের মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করে গেছে। বাঙালিদের ওপর হত্যা নির্যাতনের কথা যতটা সম্ভব চেপে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মানুষকে বলা হয়েছে পাকিস্তান ভাগ করার পেছনে ছিল ভারত এবং আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অবশ্য ইন্টারনেটের যুগে এসে এখন অনেকে জেনে গেছেন এটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকদের লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার ছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকা অবশ্যই ছিল। ভারত চেয়েছে পাকিস্তান ভেঙে তার পাশে আরেকটি নতজানু রাষ্ট্র রাখতে। সুতরাং ১৯৭১ সালে ভারতের ত্যাগ শুধু বাংলাদেশের স্বার্থে নয় নিজেদের কৌশলগত কারণেও জরুরি ছিল। কিন্তু ঘরের ভেতর সমস্যা থাকলে শত্রু তো সুযোগ নেবেই। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। পাকিস্তানের একের পর এক সরকারের ব্যর্থতা দিনে দিনে বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্য এবং বঞ্চনার মনোভাব শক্ত করেছে। সর্বশেষ উচিত ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া। জুলফিকার আলী ভুট্টো তা মানেননি। সেনাবাহিনীকে রাতের আধারে নিজদেশের বাঙালি জনগণের হত্যাযজ্ঞ চালাতে সায় দিয়েছেন। তাই বরং ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকা পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকদের মুখরক্ষা করেছে। তারা অন্তত মানুষকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

বাংলাদেশকে হারানো পাকিস্তানের জন্য সব ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ের। যে বাংলাদেশকে ভৌগলিক কারণে শক্তিশালী পাকিস্তান গঠনে দূর্বল ভাবা হয়েছে, সেই বাংলাদেশ যে সীমান্তের কৌশলগত সুবিধার জন্য পাকিস্তানের আর্শিবাদ ছিল এখন তারা বুঝতে পারছে। বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানকে শত্রুরাষ্ট্র ভারতের আক্রমন থেকে বরাবরই অরক্ষিত রেখেছিল পাকিস্তানিরা। তারা ভাবতো দুটো সীমান্ত সমানভাবে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে অন্তত একটি ভালোভাবে রক্ষা করাই শ্রেয়। এখন ভারতীয়রা বলছে, বাংলাদেশ সৃষ্টি করে আমাদের লাভ কী হলো? সেই আরেকটি ফ্রন্টতো রয়েই গেল। তার মানে পৃথক দুটি সীমান্তের কৌশলগত ফায়দা নষ্ট করেছে পাকিস্তানিরাই।

আগেই বলছিলাম, এই পথ পাড়ি দিতে বাংলাদেশকে কম ঝড় ঝঞ্ঝা সইতে হয়নি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতি বিপ্লবের মুখে পড়তে হয়েছে। তার আগে বন্যা, অর্থনৈতিক দুর্দশা, এমনকি ১৯৭৪ সালে একটি দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে হয়েছে। ছোট দেশ, বিপুল জনসংখ্যা- দেশটি আদৌ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে কিনা, কিভাবে চলবে- এটি ছিল আন্তর্জাতিক মহলেও সঙ্কা। ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পাকিস্তানপন্থীরা আবার ক্ষমতায় আসে। দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে দেশটির বিক্ষুব্দ রাজনীতি অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ সময়ে দক্ষ জনশক্তি বেড়ে উঠেনি, শিক্ষা-সংস্কৃতি-আমলাতন্ত্র- সর্বক্ষেত্রে মেধাশূন্যতা চোখে পড়েছে। ছা-পোষা বুদ্ধিজীবী সমাজ গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে ভূমিকা রাখেনি। তারপরও নারী-পুরুষ কাধে কাধ মিলিয়ে পরিশ্রমি জনতা হয়ে দেশটিকে বিশ্বের দরবারে মোটামুটি সন্মানজনকস্থানে এগিয়ে নিয়েছে।

যুদ্ধে একেবারে বিধ্বস্ত অবকাঠামো থেকে একটি চলনসই অবকাঠামো তৈরি করেছে। মাইনাস ১২ জিডিপির রাষ্ট্র দুই অংকের জিডিপির দেশ হওয়ার পথে। স্বাধীনতার সময় লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। আর খাদ্য ঘাটতি ছিল সাড়ে সাতাশ লক্ষ টন। এখন জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কমিয়ে এনেছে। খাদ্য উৎপাদন তিনগুণ বাড়িয়েছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল এরিয়ার দেশ ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। এদেশের মাটি এদেশের মানুষের খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে এটা তো কম বড় উন্নয়ন নয়।

নতুন নতুন উদ্ভাবন ছাড়া এ জাতির টিকে থাকার ভরসা কোথায়! কৃষিমন্ত্রী কৃষি বিজ্ঞানীদের বলেছিলেন লবণের মাটিতে ধান উৎপাদন করতে হবে। লক্ষ লক্ষ একর উপকূলীয় এলাকার জমিতে লবণাক্ততার কারণে ধান উৎপাদন হতো না। এখন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা লবণ সহনীয় ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। এ যদি না হয় কোটি কোটি মানুষের খাদ্য সরবরাহ হবে কীভাবে? এখানে জায়গা কম মানুষ বেশি। সুতরাং এ জাতির সন্তানদের এক মুহূর্ত অলসভাবে বসে থাকার কোনও অবকাশ নেই।

বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে, এটি পরিমাপ করতে তার পূর্ব দেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা চলে। ভারত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ থেকে শক্ত অর্থনীতির দেশ কিন্তু বাংলাদেশকে লজ্জায় ফেলার মতো নয়। বরং ভারত হিন্দুত্ববাদিদের হাতে পড়ে এখন পেছনের দিকে হাঁটছে। পাকিস্তান নানা চড়াই উৎরাইয়ের পরও এখনও সঠিক রাস্তা পায়নি। সব কটি সূচকে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র। বাংলাদেশের টাকা পাকিস্তানের মৃদ্রার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ তুমি দীর্ঘজীবী হও!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।