রক্তমাখা অস্ত্র হাতে রক্তমাখা আঁখি
জাফর ওয়াজেদ
গণহত্যা, রক্তপাত, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। শত্রু হননের গান গাইতে গাইতে তিমির বিদারী উদার অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু সেই বিজয়ের পতাকাকে অবনমিত করে পরাজিত শক্তি ও শত্রুদের সমাজে এবং মসনদে আসীন হবার ঘটনাও ঘটেছে অবলীলায়। যারা স্বাধীনতা চায়নি, চায়নি জাতি হিসেবে বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠা, তারা তাদের শাণিত ক্ষুরধার অস্ত্রকে সমর্পণ করেনি। বরং আরও ধারালো করে উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে আসছে। হামলাকারীদের দৃষ্টিতে তারা অতীতে ফিরে যাবার জন্য অর্থাৎ পাকিস্তানী ভাবাদর্শ ও মানসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি একটি কনফেডারেশন গড়ে তোলার জন্য ১৯৭২ সাল থেকেই দেশে-বিদেশে তৎপরতা চালিয়ে আসছে।
একনাগাড়ে গত ৪৪ বছর ধরে তারা সক্রিয় এবং তৎপর। সহযোগী হিসেবে তারা পেয়েছে সমমর্মী ও সমধর্মী জান্তা শাসকের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকে। এরা মিলেমিশে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে খাদের অতলে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে তারা তাদের সশস্ত্র তৎপরতা এমনভাবে বাড়িয়ে চলেছে, যা একাত্তরে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ঘুণাক্ষরেও তারা ভাবতে পারেনি গণহত্যাকারী তাদের দলনেতা-কর্মীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজে তারা তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করার জন্য নানাবিধ ও নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়েও স্বাভাবিক পন্থায় জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি।
অর্থ ও অস্ত্রবলে গরীয়ান হয়ে তারা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পেরেছিল। সেই রেশ ধরে দেশে তারা জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের বিস্তার ঘটিয়েছে। একাত্তর সালে তারা তাদের শিক্ষকদেরও বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে এসে নৃশংস ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে। সেই তারাই এখন তাদের পাপের বিচার ও সাজা রুখে দিতে হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে আসছে। তারা শুধু মুক্তমনা, বুদ্ধিজীবী হত্যা করছে তা নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ নিধনেও সক্রিয়। তাই দেখা যায়, গত তিন বছরে তারা ২১ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। অতীতে পুলিশ সদস্যদের ওপর প্রকাশ্য হামলা চালানো হলেও সম্প্রতি গুপ্তহত্যা চালানো হচ্ছে। কেন পুলিশের ওপর এই হামলা তার অর্থ সুস্পষ্ট।
পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়া গেলে দেশকে অস্থিতিশীল করা সহজ হয় এবং এই অরাজক পরিস্থিতিই পারে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা এবং সরকারকে বিপর্যস্ত করতে। হত্যাকারীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এসবে মদদ দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। ঢাকায় আটক জেএমবির সদস্যদের মধ্যে পাকিস্তানী নাগরিক থাকাই প্রমাণ করে যে, এরা আইএসআই-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং নাশকতা পরিচালনায় সামর্থ্যবান। দেশী জঙ্গীদের সঙ্গে মুম্বাই হামলার প্রধান শিরোমণি দাউদ ইব্রাহিম যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। ‘আন্ডার ওর্য়াল্ড ডন’ হিসেবে খ্যাত দাউদের সঙ্গে অতীতে তারেকের বৈঠকের ঘটনাই জানান দেয় তাদের সম্পর্ক এখনও অটুট। এদের অর্থ ও অস্ত্রবল এবং জঙ্গী নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। এরা অর্থের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গ্রেফতার হওয়া দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগী ভারতের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছোটা রাজনও বলেছে, ভারতের পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গেও দাউদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশেও যে তারা তা করতে পারে না তা নয়। তাদের প্রভাববলয় অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বিদেশী পরিমণ্ডলের সঙ্গে দেশীয় যোগাযোগ বাড়ার কারণে অপরাধীরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। সেক্ষেত্রে পুলিশের বেশিরভাগ সদস্যই কাজ করছেন পুরনো ধারায়। সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, দক্ষতা এবং দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান করে কাজে লাগাতে না পারলে এই সময়ে অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সংস্কার কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দেখা গেছে, পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে চোরাগোপ্তা হামলাসহ জঙ্গী প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ নেই। তাদের ওপর যে হামলা হচ্ছে আক্রান্তরা সেজন্য প্রস্তুত নয়। তাদের মনোজগতে এটা কাজ করে না যে, সাধারণ সময়ে বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালে তাদের ওপর এ ধরনের হামলা হতে পারে। যে কারণে একজন পুলিশকে যখন কোপানো হচ্ছে তখন অন্যরা রাইফেল হাতে থাকা স্বত্ত্বেও প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। তাই এদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অপরাধীরা তাদের কৌশল ও ধরনে পরিবর্তন আনছে প্রতিমুহূর্তে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। জঙ্গীরা কৌশল পরিবর্তন করে হামলা চালিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেলেও আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে পুলিশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ অপরাধ তদন্তে পুলিশের বিশেষ কোন ইউনিট না থাকায় জঙ্গীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে আগাম তথ্য পাওয়া গেলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা কেন নেয়া যাচ্ছে না তা অনুসন্ধানও করা হয় না। আরও বড় সমস্যা হচ্ছে, জঙ্গীদের বিরুদ্ধে চার্জশিটগুলো অত্যন্ত দুর্বল। যে কারণে জঙ্গীরা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আনসারউল্লাহ বাংলা টিম প্রধান জসীমউদ্দিন রুহানীকে এক বছর আগে গ্রেফতার করা হলেও তার কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করা হয়নি বা যায়নি। অভিযোগ পাওয়া যায়, দুর্বল কারা ব্যবস্থার কারণে রুহানী কারাগারে বসেই তার বাহিনীকে পরিচালনা করছেন। এমনকি অস্ত্র কারখানা গড়ে তোলা বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল নেতা মুফতি ইজহারউদ্দিনকে দীর্ঘ সময় পর গ্রেফতার করা হলেও দ্রুত বিচারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এমনকি জিজ্ঞাসাবাদও গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়নি। ফলে এদের নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলছে না। পুলিশের অদক্ষতা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তাদের জন্যও। তাদের হাত থেকে জেএমবির সদস্যরা পালিয়ে যাবার মতো সক্ষমতাও দেখিয়েছে। এত ঢিলেঢালা ভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন মানেই নিজেদের পায়ে নিজে কুড়াল মারার অবস্থায় উপনীত হওয়া। তাদের তো জানা উচিত, নিজেকে আর নিজের শত্রুকে চেনা থাকলে কোন হার ছাড়াই একশ’ যুদ্ধে জেতা যায়। এখন তো শত্রু চিহ্নিত হয়ে আছে এমনটা বলা যায় না। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় তারাই দেশের শত্রু। এই শত্রু একাত্তরের স্বাধীনতা এবং দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে গণহত্যা চালিয়েছে। আজও সেই অবস্থান থেকে সরে আসেনি।
রবীন্দ্রনাথ একত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯২ সালে লিখেছিলেন, ‘সমাজের প্রধান বল নীতিবল যখন চলিয়া গিয়াছে তখন তাহাকে বেশীদিন কেহই ভয় করিবে না। যে সমাজ মিথ্যাকে কপটতাকে মার্জনা করে, যাহার নিয়মের মধ্যে কোন নৈতিক কারণ, কোন যৌক্তিক সঙ্গতি নাই, সে নিতান্ত দুর্বল। সমাজের সমস্ত বিশ্বাস যদি দৃঢ় হইত, যদি সেই অখন্ড বিশ্বাস অনুসারে সে নিজের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রিত করিত, তবে তাহাকে লঙ্ঘন করা বড়ো দুরূহ হইত।’
বাস্তব যে, ভণ্ড মোনাফেকদের কোন আদর্শগত বিশ্বাস নেই। এ শ্রেণীর লোক যদি সমাজের সমাজপতি হয়ে ওঠে তাহলে সে সমাজ সর্ববিষয়ে আস্থাহীন হয়ে পড়ে। এ রকম অবস্থাকেই নৈরাজ্য ও মাৎস্যন্যায় বলা হয়। এমনটাই বাংলাদেশ দেখেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের পর বলা হয়, সমাজ নকশিকাঁথার মতো একটি জটিল গ্রন্থন। নকশিকাঁথাকে কেটে টুকরো টুকরো করলে সেটা না থাকে কাঁথা, না থাকে শিল্পকর্ম। ‘ইসলামী’ হুকুমত পাকিস্তানের ‘ইসলামী’ সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ধর্মীয়সহ সকল প্রকার নীতিশাস্ত্র হত্যা করে গেছে। ধর্মের লেবাসধারী দেশীয় ভণ্ড মোনাফেকরা শুধু মানুষ হত্যার সহযোগী ছিল না, ধর্মীয় ও জাগতিক নীতিশাস্ত্র এবং আইন-কানুন হত্যারও সহযোগী ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তারা সরকারী আনুকূল্যে সমাজে, রাজনীতিতে, ক্ষমতায় সর্বত্র পুনর্বাসিত হয়েছে। নীতি হত্যাকরাীরা কখনও নীতি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সে যুগের চোখ খোলা সমাজে সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোকের জন্য এক প্রকার নীতি এবং অপর বৃহত্তর অংশ সাধারণ মানুষের জন্য অন্য প্রকার নীতি প্রেসক্রিপশন দিলে সেটা গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। সে সময় খুনিরা শুধু মুক্ত নয়, অনেকে উচ্চপদে সরকারী চাকরি করেছে। অন্যরা স্বাধীনভাবে রাজনীতি করছে এবং সংগঠিত হয়েছে দেশকে পশ্চাৎপদে নিয়ে যাবার জন্য। অপরদিকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সজ্ঞানে সহযোগিতা করেছিল এবং অগণিত বাঙালীকে হত্যা করেছিল, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাঙালী হত্যার কর্মকে সঠিক কর্মরূপে সদম্ভে ঘোষণা করে এদেশে অবাধে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী রাজনীতি করে আসছে।
শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে সমাজে। কিন্তু সে শিক্ষা শিক্ষিতজনদের মধ্যে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাচ্ছে তা বলা যায় না সর্বার্থে। আজকাল প্রায় প্রতি গ্রামে পাঠশালা রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যাও একাধিক। দেশে কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে। সেইসঙ্গে উচ্চ শিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়। যার মধ্যে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামগুলোও বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তুলেছে। শিক্ষিতরা গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। নিরক্ষর গ্রামবাসীর সঙ্গেও তারা মেলামেশা করে। তবু সমাজে আলো প্রবেশ করে না। কে ছড়াবে এই আলো? আলোকিত মানুষ তৈরির ঘোষণা দিয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে বলা হয়, সেইসব প্রতিষ্ঠান কোন আলোকিত মানুষ উপহার দিতে পারছে তা নয়। বরং মুক্তমনা ও চিন্তার অবাধ প্রবাহ রুখে দিচ্ছে যেন।
‘পুঁথি’ পুস্তকের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা শিক্ষা সম্ভবত সে মানুষকে আলোকিত করছে না। অনালোকিত মানুষকে অন্ধকারের দিকেই যেন ধাবিত করছে। যারা শিক্ষিতরূপে পরিচিত শিক্ষা ব্যবস্থা যে তাদের মস্তিষ্ককে শোধনের কার্য সমাপ্ত করে দিয়েছে, অন্ধ কি কখনও অন্য অন্ধকে পথ দেখাতে পারে? তাই দেখা যায়, তিক্ত অভিজ্ঞতা যে পথ ও মত ভ্রান্ত এবং জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রতিপন্ন করেছে সেই ভ্রান্ত মত ও পথকেই দেশবাসীর সামনে নানা কৌশলে পুনরায় উত্থাপন করা হয়। পশ্চাতে ফেলে আসা গোমরাহীকে পুনরায় গ্রহণ করার জন্য সাধারণ মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করা হয়। এ ব্যাপারে অর্থের অভাব হয় না। সরকারী-বেসরকারী অর্থও পাওয়া যায়। শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি প্রচারের জন্য বিদ্যালয় তো রয়েছে ভূরি ভূরি। এসব স্থানে যা শিক্ষা দেয়া হয় তা গোঁড়ামি ও মূলত অন্ধতাকে প্রাধান্য দেয়।
জনগণের মনে ও মস্তিষ্কে গোমরাহীর সীলমোহর মারার জন্য ওই ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয় মনে করে স্বার্থান্ধ শ্রেণী বিপুল টাকাকড়ি ব্যয়ে সভা-সমিতি প্রভৃতির আয়োজন করেও গোমরাহীর প্রচার করেন। তা প্রচারের মুখপাত্ররা নিযুক্ত আছেন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সংবাদপত্র অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থানে। আছেন মধ্যবিত্ত সমাজেও। সামাজিক পরগাছারূপে যারা জীবন ধারণ করেন তারা তো আছেনই। তাই একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরছে দেশবাসী। এ যেন এক আবর্ত। এই আবর্ত হতে মুক্তির পথ নেই। সে কারণেই দেখা গেছে পঁচাত্তর পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের অপতৎপরতা। একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যায় সজ্ঞানে শরিক বিদেশী অর্থপুষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধীরা ধর্মের নামে সরলমনা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে দেশটাকে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং তার আশ্রিত এজেন্ট পেট্রোডলারে ধনী মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে বিকিয়ে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র তথা পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরে যাওয়ার জন্য হেন অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য কলঙ্কজনক।
যুদ্ধাপরাধী ও তাদের অনুসারীরা যে কত ধরনের হীন ষড়যন্ত্র দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে করে আসছে তা দমনে সর্বোপরি সফলতা অর্জন করা যাচ্ছে না। নানা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানও এদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাজাদানে যত বিলম্ব হবে ততই নাশকতার ক্ষেত্রটি প্রসারিত হবে। যা কাম্য হতে পারে না স্বাধীন জাতির জন্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘রক্তমাখা অস্ত্র হাতে রক্তমাখা আঁখি/শিশু পাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।’ কিন্তু বাস্তবের রক্তমাখা সশস্ত্র হাতকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া যাচ্ছে না। অথচ সেটাই হওয়া উচিত সর্বাগ্রে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/এমএস