আই অ্যাম অ্যা ম্যান অব ব্রোকেন হার্ট
: আই অ্যাম অ্যা ম্যান অব ব্রোকেন হার্ট; অতএব, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি...
ছবদর আলীর কথা শুনে আবেদন নেছা কিছুক্ষণ তেরছা চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে বলল-
: বাংলাদেশে নদীভাঙন আর আপনের হৃদয় ভাঙন অতি নরমাল বিষয়। যতদিন জিন্দেগি আছে, ততদিন ইদানীংকালের ধারাবাহিক মেগা সিরিয়ালের মতো ভাঙনের এ খেলা চলতেই থাকবে। কাজেই এই চাপ্টার ক্লোজ কইরা গো টু কাঁচাবাজার। ঘরে মাছ-তরিতরকারি কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নাই।
বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না ছবদর আলীর। আবেদন নেছা কথার হুলে যতই তাকে বিদ্ধ করুক; হৃদয় ভাঙার নিয়তি থেকে নিস্তার নেই তার। একেক দিন এক একটা ঘটনা ঘটে কিংবা ভাবনা উদয় হয় ছবদর আলীর মনে আর তা শেষ হয় হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই যেমন কয়েকদিন আগে হঠাৎ মনে হলো, বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বয়স বেড়ে যাওয়া মানে বুড়া হয়ে যাওয়া। আর বুড়া হয়ে যাওয়া মানে জীবনের সব রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া। তার বয়স বাড়বে কেন? হোয়াই? ছবদর আলীর এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তখন সেখানে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কাজেই উত্তর না পেয়ে প্রথমে সৃষ্টিকর্তার ওপর অভিমান এবং পরে হৃদয় ভাঙনের শিকার হলো ছবদর আলী।
আজ যে কারণে হৃদয় ভেঙেছে ছবদর আলীর, তার মূলে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ। বৃষ্টি বাদলে আচ্ছন্ন বিগত কয়টা দিন অতি উত্তম কেটেছে তার। খাবার-দাবারে একটু উল্টাপাল্টা হলে আগে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠত ছবদর আলী। কিন্তু জাওয়াদ চলাকালীন চানাচুর-মুড়ি, ভুনা খিচুড়ি দিয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলার পরও তার যে গ্যাস্ট্রিকের ব্যামো আছে, এটা টের পাওয়া যায়নি।
শুধু তাই নয়, আগে বাজারে যাওয়া মানেই হচ্ছে দোকানদারের সঙ্গে ঝগড়া অবধারিত। বিশ টাকা কেজির আলু কেন চল্লিশ টাকা, আশি টাকা কেজির ডাল কেন একশ দশ টাকা, ত্রিশ টাকা কেজির পেঁয়াজ কেন আশি টাকা, আশি টাকা কেজির রসুন কেন একশ ষাট টাকা ইত্যাদি নিয়ে চলতো বিবাদ-কথাকাটাকাটি। অথচ জাওয়াদের কল্যাণে গত কয়েকদিন বাজারে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই মিলেছিল।
বাজারের চিন্তার পরিবর্তে সারাক্ষণ মাথায় গিজগিজ করেছে বাদল দিনের গান। জাওয়াদের প্রস্রব করা বৃষ্টি যেন হয়ে উঠেছিল কৈশোরের সেই প্রথম ভাল লাগা মানুষ, যে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল এবং হঠাৎ আবার তার খোঁজ পাওয়া গেছে। উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর আবেগ সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছিল তাকে ঘিরে। কিন্তু এত ভালোবাসা, এত অনুরাগ দিয়েও তাকে ধরে রাখা গেল না। সে চলে গেল। কেন চলে গেল, এই দুঃখেই হৃদয় ভেঙেছে ছবদর আলীর।
ভাঙা হৃদয় নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকাটা দোষের কিছু নয়। তবে মুশকিল একটাই। খালি পেট হৃদয়বৃত্তির এ চর্চাকে সমর্থন করে না। আগে উদর পূর্ণ করো, তারপর মন চাইলে গান গাও, বাজনা বাজাও অথবা দুঃখ বিলাসে নিমগ্ন হও। আবেদন নেছা এ কথাটিই ছবদর আলীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল-
: এইবার দয়া কইরা বিছানা ত্যাগ করেন।
: হু।
: হু কী! বেলা বাজে বারোটা। এরপর তো বাজারে মাছি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না!
: এই যে উঠতেছি...
: উঠতেছি বইলা বাম কাইত থেইকা ডাইন কাইতে শুইলে আর উঠা হবে না।
: পাঁচ মিনিট সময় দেও। ঘড়ি ধইরা জাস্ট ফাইভ মিনিট। শেষবারের মতো হার্টে একটা প্রলেপ মাইরা লই।
বাজারে যাওয়ার পথে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। ছবদর আলী হাত তুলে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল-
: কেমন আছেন?
: এই কয়দিন ভালোই ছিলাম। কিন্তু এখন...
: এখন?
: এখন আর ভালো নাই। বৃষ্টির আমেজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সবকিছু আগের মতো হইয়া গেছে। অথচ বিগত কয়দিন টেনশন কী জিনিস, টের পাই নাই; দাম্পত্য কলহ কী জিনিস, বুঝতে পারি নাই। আহা! ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট সব ফকফকা। জ্যামফ্যামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আহ! কী সুখেই না কাটছে এই কয়টা দিন। এখন বৃষ্টিও নাই, সুখও নাই। কী, ঠিক কইলাম কি না?
: জি। আমি আপনের সঙ্গে শতভাগ একমত পোষণ করতেছি। বৃষ্টি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হৃদয় ভাঙনের শিকার হইছি।
: কী ভাঙনের শিকার হইছেন?
: হৃদয়। হার্ট।
: হার্টের অসুখ হইছে আপনার?
: জি।
: এখন কি অবস্থা?
: অবস্থা সিরিয়াস।
: ছবদর সাহেব, ডোন্ট মাইন্ড। হাসপাতালে অ্যাডমিশন নেওয়ার আগে এই মাসের বাড়ি ভাড়াটা কাইন্ডলি দিয়া যাবেন।
এই রে! বাড়িওয়ালা কী বুঝতে কি বুঝল! ছবদর আলী ভাবে, এটাও জাওয়াদের প্রস্থানজনিত কুফল। জাওয়াদ থাকাকালীন এমন বৈষয়িক ভাবনা বাড়িওয়ালার মাথায় কিছুতেই আসতো না। কিন্তু এখন এসেছে। কারণ, এখন জাওয়াদ নেই।
বাজারে যেতে যেতে ছবদর আলীর মনে হলো, জাওয়াদ যদি তার ভাই-ভাতিজা, চাচি-খালা সহযোগে বছরব্যাপী ঢাকা শহরে আস্তানা গাড়ত, তাহলে খুবই সুবিধা হতো। বাড়িওয়ালা ভাড়া চাইতে ভুলে যেত। আবেদন নেছা বাজার নিয়ে ঝগড়া করা ভুলে যেত। এর ফলে সবচেয়ে আরামে থাকত ছবদার আলী নিজে। আল্লাহপাক ঝড়-বৃষ্টি, মেঘ-বাদলের দেখভাল করার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন হজরত মিকাইল (আ.) ওপর। বাজারে যেতে যেতে ছবদর আলী ভাবে-
: ইস! যদি কলেবলে কোনো প্রকারে হজরতের (আ.) সঙ্গে একবার দেখা হইত, তাইলে চাতক পাখির নাম কইরা একটা দরখাস্ত পেশ কইরা দিতাম- বৃষ্টি দেন হজরত (আ.); বৃষ্টি দেন।
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক ।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস