রোকেয়ার স্বপ্নের বাংলাদেশ কতটা নারীর হলো?
আজ বেগম রোকেয়া দিবস। আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে এই বঙ্গে একজন নারীর জন্ম হয়েছিলো যিনি নারীর জন্য একটি বিশ্ব, একটি দেশ, একটি স্বার্বভৌমত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কাজ করেছিলেন। লড়াই করেছিলেন।
প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আমরা বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষ্যে নানা বক্তৃতা, বিবৃতি দেই। কলাম লেখি। এই একইদিনে তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন। একইরকম লেখার মধ্য দিয়েই স্মরণ করি সেই লড়াকু নারীকে। এবার ভাবলাম ভাবনাটাকে একটু উল্টেপাল্টে দেখার চেষ্টা করি। তাই বেগম রোকেয়া দিবসে আমি আমার বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছি।
বেগম রোকেয়া জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলায়। তাঁর সময়ে না ছিলো পূর্ব বঙ্গ বা পশ্চিম বঙ্গের হিসেব না ছিলো বাংলাদেশ। তবে তিনি জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের মাটিতেই। তাই হয়তো তিনি যতটা না গোটা বাংলার তার চেয়ে বেশি এই বাংলাদেশের।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষা বা কী তিনি চেয়েছিলেন সেসব কম বেশি যারা পড়াশুনা করেন তাদের সবারই জানা। যারা জানেনা তাদের জন্য গুগলতো রয়েছেই। তাই বেগম রোকেয়ার চাওয়া নাম দিতে চেয়েও দিলাম না। বাস্তবে, আমরা জন্মেছি এই বাংলাদেশে। তাই এই বাংলাদেশকে জানতে চাই, চিনতে চাই আর নারী হিসেবে আমার অধিকারের কথা, চাওয়ার কথা, প্রাপ্যতার হিসাব করতে শিখেছি এই বেগম রোকেয়ার কাছ থেকেই। তিনিইতো আমাকে বুঝিয়েছেন একটি দেশে নারী বা পুরুষের মধ্যে অধিকারের হিসেবে থাকবেনা কোন পার্থক্য। একজন পুরুষ যেমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে ঠিক তেমনি পারবে একজন নারীও। পরিবার থেকে সমাজে নারীকে দেখা হবে একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে, নারী হিসেবে নয়। এই যে আজকে আমি আমার মানবিক মর্যাদার লড়াইয়ের কথা বলি, সেটাওতো বেগম রোকেয়াই প্রথম বলে গেছেন।
আর তাইতো আমার দেশের কাছ থেকে আমি আমার মর্যাদাটুকু পই পই হিসাব করে আদায় করে নিতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা আমাদেরকে কী বলে? কোন ইঙ্গিত দেয়? কতটা এগুলাম আমরা বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের সেই নারী রাজ্যের পথে? নারীরা হয়তো আগের মতো গৃহবন্দি নয় কিন্তু শৃঙ্খলমুক্তি কি তাদের হয়েছে? নারীরা কি নিজের মত করে চিন্তা করতে পারে? নিজের আয়ের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? ধর্মের দোহাই দিয়ে কি নারীদের এখনও বন্দী করে রাখার চেষ্টা হয়না? পরিবার থেকে সমাজ, সব জায়গায় কি নারীদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেয়া হচ্ছে?
এই যে এতসব প্রশ্ন, প্রতিটা উত্তরে আমাদেরকে থামতে হবে। এক বাক্যে দেয়ার মত বাস্তবতা আমরা পাইনি আজও। আজও আমাদেরকে মিছিল করতে হয়, “নারীর অধিকার মানবাধিকার” বলে। আজও রাষ্ট্রের কাছে আমাদের আবেদন, নিবেদন করে বলতে হয় আমার বিরুদ্ধে হওয়া সকল নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ, বিচার? হায়!! নারীর সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার বিচারের পরিসংখ্যান যে পাওয়া যায় না। কথায় কথায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে বাসের কন্ডাক্টর, হেলপারও নারীকে ধর্ষণের হুমকি দেয় কী অবলীলায়। নারীর অস্তিত্ব যেন এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
যে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া লড়াই করে গেছেন ১০০ বছর পূর্বে সেই বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয় আজকের দিনেও। আমার লেখা পড়ে অনেকেই হয়তো ভাবতেই পারেন, তাহলে কি গত ১০০ বছরে এই বাংলার নারী একদমই আগায়নি? এগিয়েছে। নারীরা ভাষা আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মাঠের লড়াইয়ে এই বাংলার নারীর অংশগ্রহণ সবসময়ই উল্লেখযোগ্য কিন্তু গুটিকতক নারীর সাফল্য দিয়ে কি সারা বাংলার নারীর সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায়? আমরা কি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পেরেছি? পেরেছি কি একজন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে?
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে। এইতো আর এক সপ্তাহ পরেই আমাদের বিজয় দিবস। গত ৫০ বছরের নারীর অর্জন বলতে কী কী আছে? কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পদায়ন ব্যতিত কর্মক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্বের জন্য কতটা প্রস্তুত আমরা? পোশাক ক্ষেত্র ব্যতীত আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে নারীর গণ অংশগ্রহণ বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে? অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সফলতার পরিসংখ্যান আছে আমাদের সামনে। এমনকি নারীকেন্দ্রিক অনেক অর্জনও আছে। আছে বৈশ্বিক স্বীকৃতিও কিন্তু তার কতভাগ নারীর গৃহে পৌঁছেছে?
আসলে নারীর অর্জন কিছু হয়েছে কিন্তু তার বেশিরভাগই এসেছে বিচ্ছিন্নভাবে। একটি নারীবান্ধব পরিবেশ বা নারীর জন্য বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে সামগ্রিক পরিকল্পনার দরকার ছিলো সেই কাজটি হয়নি। নারীর লড়াইটি এখনও কেবল নারীরই আছে। সামগ্রিক করতে পারিনি কোনদিকেই। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা যেদিন সকলের ঘটনা বলে স্বীকৃতি পাবে সেদিন সফল হবে বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন। একজন নারীও যখন রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে বা পরিবারে নির্যাতনের শিকার হবেনা সেদিন বুঝবো আমরা বেগম রোকেয়াকে ধারণ করেছি। ধর্মের দোহাই দিয়ে যেদিন নারীর এগিয়ে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হবেনা সেদিন “সুলতানার স্বপ্ন” পূরণ হবে।
পারিবারিক অর্থনীতি থেকে রাষ্ট্রীয় অর্জনের যেদিন আলাদা করে নারীর অর্জনকে উল্লেখ করা যাবে সেদিন “বেগম রোকেয়া দিবস” পালন প্রশ্নাতীত হবে। মনে কোন ক্লেশ থাকবে না যে কেবল লেখার জন্যই বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করছি আমরা। আমরা নারীরা সেইরকম একটি দিনের অপেক্ষায় রইলাম যেদিন একবাক্যে বলতে পারবো, “হে বঙ্গনারী, আজ তুমি সফল। এই দেশ তোমার সকল নাগরিক অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। তুমি আজ থেকে স্বাধীন। রাস্তায় তোমাকে কেউ নিগ্রহ করবে না, পরিবহনে চলতে গিয়ে কেউ তোমাকে হয়রানি করবে না। আর কোন পুরুষ তোমাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার সাহস পাবে না।” ততদিন পর্যন্ত বেগম রোকেয়ার লড়াইটাকে সামনে আনা জরুরি। তাঁকে ভুলে যাওয়া মানে নারীরা নিজেদেরকে ভুলে যাবে। বেগম রোকেয়ার শিক্ষা তাই বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে শিখায়।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম