শান্তি চুক্তির দুই যুগ এবং আঞ্চলিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৯ পিএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২১

কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত কাজী শরীফ উদ্দিন

আজ ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্ণ হল I হাজার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আদিবাসীদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন I এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদ সমস্যার সমাধানে রাজ রাজনৈতিক সমাধানের দীর্ঘদিনের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করেন I সে কারণেই প্রতিবছর দোসরা ডিসেম্বর এলেই পাহাড় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গন, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মিডিয়াতে শান্তি চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় I শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন, অর্জুন ,ব্যর্থতা ,পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে চুলচেরা আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয় I

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় , পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রাজনৈতিক সমাধান কল্পে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সংলাপের সূচনা করেছিলেন I তার সময়ে সিনিয়র মন্ত্রী মশিউর রহমানসহ কয়েকজন মন্ত্রী বারবার এই আলোচনা করেন I এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এরশাদ সরকার আমলে ৬,, বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ১৩ টি এবং শেখ হাসিনা সরকারের সাথে সাতটি মিলে মোট ২৬ টি সংলাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়I তবে শুরু থেকেই এ চুক্তির কিছু ধারা নিয়ে প্রবল বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে I

শান্তিচুক্তি সম্পাদনের আজ ২৪ বছর পূর্তি হতে চলেছে, তথাপি পার্বত্য শান্তিচুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো আজ অবধি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। আমরা সবাই জানি যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ, জুম্ম জাতিগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা এবং তাদের নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সুরক্ষার ভিত্তিতে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের জন্য স্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথমে গণতান্ত্রিক ও পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে। সশস্ত্র সংগ্রামরত অবস্থায় সাতবার বৈঠকের পর শেখ হাসিনা সরকার আঞ্চলিক পরিষদসংবলিত স্বশাসন প্রদানে সম্মত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়।

শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই এর বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে I এর মধ্যে অন্যতম প্রধান বিতর্ক হচ্ছে “ অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার “ I শান্তিচুক্তির খন্ডের ১৭ (ক) ধারা ধারা অস্থায়ী সেনাক্যাম্প অপসারণের কথা বলা হয়েছে I জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা ও তাদের সমর্থক সুশীল সমাজ শান্তিচুক্তির এই শর্ত বাস্তবায়িত হয়নি বলে ব্যাপক সমালোচনা করলেও সরকার পক্ষ হতে এ দাবি করে এই শর্ত আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে I বাস্তবতা হচ্ছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সরকার ইতিমধ্যেই কাপ্তাই জন হতে একটি ব্রিগেড সহ ছোট-বড় ২৪১ টি নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে I কিন্তু নিরাপত্তা অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে , সরকার যে সকল নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে , উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন কৌশলে সেসকল নিরাপত্তা ক্যাম্পের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিয়েছে I

অনুসন্ধানের তথ্যমতে এ পর্যন্ত সিক্সটি নাইন টি প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন কৌশলে দখল করে নিয়েছে I কোথাও ধর্মীয় স্থাপনা, কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান , বা কোথাও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এসব নিরাপত্তা দখল করে নিয়ে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা সেখানে তাদের অস্থায়ী গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে I এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর ব্যাপক হুমকি সৃষ্টি হয়েছেI কেননা , এসকল ক্যাম্পগুলোর ভূকৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ I স্থানীয়দের অভিযোগ , যেসব এলাকার ক্যাম্প উঠিয়ে নেয়া হয়েছে সেসব এলাকায় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অভয় অরণ্যে পরিণত হয়েছে I ফলে উক্ত এলাকাবাসী এবং সাধারণ নিরীহ জনগণ পুনরায় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে I সরকার দীর্ঘদিনের এই দাবি মূল্যায়ন করে ইতোমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্প গুলোর স্থান সংরক্ষণ করে পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে I

বিশেষ মহল থেকে বারবার প্রশ্ন হল শান্তিচুক্তির দুই যুগ পরে পাহাড়ে সেনাক্যাম্প রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু কিংবা পুলিশ ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে I একজন প্রাক্তন নিরাপত্তা সদস্য সেনা কর্মকর্তা হিসেবে এটাই আমার মুখ্য আলোচনার বিষয়I পার্বত্য চট্টগ্রাম , সব সময় স্পর্শ কত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় I সম্প্রতি বছরগুলোতে রক্ত ঝরেছে এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে I এসব হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে উত্তেজনা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে I পরিস্থিতির জন্য জন্যই অনেকেই জেনে না বুঝে সরকারকেই দায়ী করছেনI তারা বলছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারেI

আবার অনেকে দাবি করছেন, ক্ষমতা ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণে পাহাড়ি সংগঠনগুলো নিজেরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে I শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা বলছেন এটা আঞ্চলিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ এবং বারংবার তারা সাতটি কারণের কথা উল্লেখ করছেন I
১ )শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন
২ ) আঞ্চলিক ও পার্বত্য পরিষদ নির্বাচন
৩ ) অকার্যকর ভূমি কমিশন
৪ )সেনাবাহিনীর উপস্থিতি
৫ ) পাহাড়িদের বিভেদ
৬ ) বাঙালিদের বসতি এবং অবিশ্বাস
৭ ) পিছিয়ে পড়া উন্নয়ন ও দুর্গম এলাকা
মূলত আমার আলোচনার বিষয় এই চতুর্থ পয়েন্ট - সেনাবাহিনীর উপস্থিতি I
শান্তি চুক্তির ঘ খন্ডের ১৭ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, “সরকারও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং তিন জেলা সদরে তিনটি স্থায়ী সেনানিবাস ( আলীকদম, রুমা ও দিঘীনালা ) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাস ফেরত নেওয়া হবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে। আইন শৃঙ্খলা অবনতি ক্ষেত্রে , প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় , এবং জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার নেয় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণ করে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে I এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন।’

এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে , শান্তি চুক্তিতে ৬ টি স্থায়ী সেনানিবাসের কথা বলা হয়েছে I কিন্তু সেই সেনানিবাস গুলোর ফর্মেশন এর কথা চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই I এই ৬ টি স্থায়ী সেনানিবাস কিরূপে সেখানে অবস্থান করবে - ডিভিশন আকারে , ব্রিগেড আকারে না ব্যাটেলিয়ান আকারে তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয় নাই I এই অপশনটি রাষ্ট্রের হাতেই রয়ে গেছে I রাষ্ট্র চাইলে প্রয়োজনমতো তা ব্যবহার করতে পারবে I

এই চুক্তির ঘ খন্ডের ১৭ (ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে I এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি , তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞা ও দেয়া নেই I অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড ব্যাটেলিয়ান,কম্পানি স্থাপনা নাকি সেনা আউটপোস্ট বুঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি I এ ব্যাখ্যাটাও সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে I

একই ধারায় আরো বলা হয়েছে, “ আইন শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে,প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার নেয় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাবে I” উল্লেখিত বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা অবলুপ্তির ক্ষেত্রে বা জাতীয় অন্যান্য দরকারে রাষ্ট্র প্রয়োজন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানেই প্রয়োজন যেকোনো ফরমেশনে সেনাবাহিনী রাখতে পারবে I এক্ষেত্রে চারটি ব্রিগেড বা ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বিবেচ্য নয় - রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনই মূল বিবেচ্য বিষয় I

একই ধারায় আরো গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তা হল, সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার শর্ত বাস্তবায়িত হতে হবে :‘‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে…” I অর্থাৎ চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি শর্তহীন নয় I বরং এর সাথে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার শর্তযুক্ত রয়েছে I এই নিয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই যে , জেএসএসের সকল সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি I জেএসএস এবং তার সকল সদস্যকে অস্ত্র সমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি I চুক্তি অনুযায়ী হাজার ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জেএসএসের অস্ত্রসমর্পণের সময় চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণ না করে তাদেরই একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুনভাবে ইউপিডিএফ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে I এরপর স্বার্থ গত দ্বন্দ্বে জেএসএস ভেঙে যায় এবং জেএসএস (এমএন লারমা ) নামে নতুন আরো একটি সংগঠন তৈরি হয় I

জেএসএস মূল দল, ইউপিডিএফ এবং জে এস এস (এম এন লারমা) -এই তিন পাহাড়ি সংগঠন প্রকাশ্য এবং গুপ্ত দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে I আর গুপ্ত বা গোপন শাখা আসলে তাদের সশস্ত্র সামরিক শাখা যদিও তারা কখনই এই সামরিক শাখার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে না । বর্তমানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র গোপন রাখার কারণে I খুন , অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে Iচাচা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ সাধারণ নাগরিক তো দূরে থাক, সরকারি কর্মকর্তাদের ও বসবাস অসম্ভব I জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি পাহাড়ি সংগঠনের চাঁদা দিতে না পারলে সেখানে বসবাস যে কারো জন্য অসম্ভব I সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় পাহাড়িদের জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করে I শুধু তাই নয়, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা, বাঙালি এবং সরকারবিরোধী বিরোধী নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত I

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে মূলত পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলের 70 দশকের আগে এবং কিছু ক্যাম আশির দশকের শুরুর দিকে I এ সকল সেনা ক্যাম্প স্থাপনের তৎকালীন নিরাপত্তা ঝুঁকি , নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ , নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জনবসতি, যোগাযোগ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, কৌশলগত অবস্থান, ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিদ্রোহীদের অবস্থান, প্রভৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল I কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচার্য বিষয় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে I

অনেকেই জানেন, ভারতের সেভেন সিস্টার্স এর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিশেষ সহানুভূতির চোখে দেখত পাকিস্তান সরকার । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি মোটেই প্রযোজ্য নয় I বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন বিদেশী সন্ত্রাসী গ্রুপের অবস্থানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সেনা ক্যাম্প I কোন সন্ত্রাসী সংগঠন যাতে কোনোভাবেই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিয়েছে সেনা ক্যাম্প । শুধু ভারত নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সাথে I অত্যন্ত দুর্গম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থান রয়েছে I যারা মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর তাড়া খেয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অত্যন্ত দুর্গম সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করে I এছাড়াও রোহিঙ্গা সমস্যা, আর সমস্যা, এ অঞ্চল নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আরো অনেক নুতন নুতন মাত্রা যুক্ত হয়েছে I সার্বিক পরিস্থিতিতে এবং উপরে উল্লেখিত বর্ণনামতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ভাবনা বা সেনা ক্যাম্পের অবস্থান মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরী এবং সময়ের দাবি I

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি পরবর্তী উন্নয়ন পরিকল্পনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়ায় এই অঞ্চল এবং জনপদকে পূর্বের মত পশ্চাত্পদ বিবেচনা করা যায় না I উন্নয়নের জোয়ারে শরিক হয়েছে পার্বত্যবাসী, সড়ক, সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি ভিত্তিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অনেক জেলায় থেকে এগিয়ে গিয়েছে I সরকারি-বেসরকারি এনজিও দাতা সংস্থার বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই তিন জেলা অনেক জেলার থেকে এগিয়ে রয়েছে I নতুন নতুন রাস্তা ঘাট, সেতু নির্মাণের ফলে পাহাড়ের অনেক গভীরের মানুষের যাতায়াত ও বসতি গড়ে উঠেছে I সমতলের পাইকাররা এসব সড়ক ব্যবহার করে পাহাড়ের অনেক ভেতর থেকে মালামাল আমদানি করতে পারছে এতে স্থানীয় উৎপাদকরা লাভবান হচ্ছে। এই নতুন সড়ক, সেতু ও বসতির নিরাপত্তা পাহাড়ের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে I

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থলবন্দর ও তিনটি সীমান্ত হাট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ফলে বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণ এবং যানবাহনের যাতায়াত, আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হতে থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প থাকবে কি থাকবে না কিংবা নতুন করে আরো সেনা ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে কিনা বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে I কারণ নিরাপত্তা ও উন্নয়ন একে অপরের সাথে জড়িত, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কখনোই উন্নয়ন সম্ভব নয় I বিশেষ করে রামগড় সাবরুম হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ভারতের যে করিডর সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে তার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে I এই রুটের সড়ক নির্মাণ ও ফেনী নদীর উপর সেতু চালু হলে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালিত হবে এই রুটেI যুক্ত হবে উন্নয়নের নতুন মাত্রা যা বাংলাদেশের অনেক জেলা শহর থেকে এগিয়ে।

পর্যটন শিল্পের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম I শুধু সেন্ট মার্টিন সুন্দরবন সাজেক নীলগিরি মানুষ কতবার দেখবে তাই আমাদের প্রয়োজন নূতন ও বৈচিত্র্যময় পর্যটন স্পট তৈরি করা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরির অপার সম্ভাবনা রয়েছে I ইতোমধ্যেই দেশের পর্যটকরা নিজ উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট আবিষ্কার করেছে I এগুলোর মধ্যে রেমাক্রি, নাফাখুম জলপ্রপাত, হাজাছড়া ঝর্ণা, রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি বান্দরবানের বিভিন্ন অংশ I সকল মহলের সার্বিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির দুই যুগে সমঝোতার মাধ্যমে আমরা সকল সমস্যার সমাধান করতে চায় I গড়ে তুলতে চাই মাতৃভূমি সোনার বাংলা I

(এ লেখায় লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণই প্রকাশিত৷)
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট। পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, এবং প্রকল্প পরিচালক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।

এইচআর/এএসএম

পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প থাকবে কি থাকবে না কিংবা নতুন করে আরো সেনা ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে কিনা বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে I কারণ নিরাপত্তা ও উন্নয়ন একে অপরের সাথে জড়িত, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কখনোই উন্নয়ন সম্ভব নয়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।