রফিকুল ইসলাম : তার কাজ অমর হয়ে থাকবে
কয়েকদিন ধরেই স্যার অসুস্থ। মনটা ছটফট করছিল। স্যার সুস্থ হবেন তো এবার? স্যারের যেন কিছু না হয়, এই প্রার্থনাই করছিলাম বারবার। কিন্তু বাস্তবতার রেখা যে বড়ই নির্মম টান দেয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মঙ্গলবার-৩০ নভেম্বর ২০২১, বিকেলে শুনলাম স্যার নেই। চোখের কোণায় এমনিতেই পানি চলে এলো। স্যারের মুখটা ভাসতে লাগলো।
জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম স্যারকে সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। যা আমার জন্য গর্বের বটে। তিনি একাধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অসংখ্য গুণীজনের শিক্ষক। তার ছাত্র-ছাত্রী দেশ বিদেশে ছড়িয়ে এখন। স্যারের কাছে করেছিলাম সাংবাদিকতা, ভাষা ও কাজী নজরুল সম্পর্কিত কোর্স। হেঁটে হেঁটে পড়াতেন, খুব কমই বসতেন। বয়স মানে না তবুও তিনি ছিলেন নিরলস। একবার শুনে নাম ঠিকই মনে রেখেছিলেন। সৈয়দ ইফতেখার বলতে কখনো ভুল করেননি। স্যারের মুখে নামটা শুনে ছাত্র হিসেবে ধন্য বটে।
সবসময় সাদামাটা জীবন ছিল স্যারের। বলতেন, নজরুল গবেষণার কথা। তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে নজরুলকে জানা-শোনার মানুষ কমে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ ছিল তার। তবে কখনো তা প্রকাশ করেননি। উল্টো বলেছেন, এই তরুণরাই হাল ধরবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে বুকে ধারণ করবে। স্যারের সেই কথা যেন সত্যি হয় সেটাই প্রত্যাশা।
স্যারকে হারিয়ে আর সবার মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক প্রবল। তবে প্রধানমন্ত্রীর শোকটা একটু বেশিই বলা যায়। শিক্ষক, গুরুজন ও অভিভাবককে হারালেন বলে বঙ্গবন্ধুকন্যা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। সরাসরি শিক্ষককে তিনি হারালেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুরা হত্যা করার পর যে কজন ছিলেন শেখ হাসিনার শুভাকাঙ্ক্ষী তার মধ্যে স্যার অন্যতম। চিরদিন পাশে থেকেছেন। আদতে যে স্যার ছিলেন আপাদমস্তক এখন খাঁটি শিক্ষক। তার গুণাবলি এখন খুব কম মানুষের মধ্যেই মেলে। তাই তো তার এতো গুণগ্রাহী। সত্যিকার অর্থেই ‘মনে প্রাণে একজন শিক্ষক’কে আমরা হারালাম।
স্যারের ছাত্র জীবন প্রসঙ্গে আসি। মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান যখন উত্তাল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র রফিকুল ইসলাম। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অনন্য। সেই সুবাদে তিনি একজন ভাষা সৈনিকও বটে। ছাত্রজীবন থেকেই স্যার ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা। সাহিত্য, নাটক, আবৃত্তি- সাংস্কৃতিক যেকোনো কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন।
প্রথম জীবনে তার একটা শখ ছিল, সেটি হলো ছবি তোলা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় দেশে যখন তেমন উন্নত ক্যামেরা ছিল না, তখন তিনি এমন কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র তুলেছিলেন, যা পরে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পেয়েছে জাতি। এ ধরনের আলোকচিত্র অন্য কেউ তুলতে পারেনি। ভাষা সংগ্রামী রফিকুল ইসলাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্নিসাক্ষীও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বন্দিশিবিরে নির্যাতিত হন, তবুও দমে যাননি আদর্শ থেকে।
১৯৫৮ সাল থেকে রফিক স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও নজরুল গবেষণায় নিয়োজিত হন। তিনি এক সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া চলতি বছর মে মাসে বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ছিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। এছাড়া আরও বহু দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রীতিমতো গবেষণা প্রয়োজন।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও অনেকগুলো বই লেখেছেন তিনি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে তার। নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত নিয়ে তার গভীর আগ্রহ ছিল, দুহাত ভরে লেখেছেন সেটি নিয়েও। নজরুল গবেষণায় তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি এ নিয়ে তরুণদের উৎসাহও দিতেন প্রচুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়া শেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি নেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসার টানেই আবার দেশে ফিরে আসেন। এমনকি মৃত্যুর আগেও বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চাননি তিনি। তবে কি স্যার বুঝতে পেরেছিলেন, সময় বেশি নেই! তবে কি স্যার এই মাটিতেই মরতে চেয়েছিলেন!
স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই নজরুল গবেষক ৮৭ বছর বয়সে চলে গেলেন ঠিকই কিন্তু তার কাজ অমর হয়ে থাকবে। রফিকুল ইসলাম ১৯৩৪ সালের পহেলা জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সারা জীবন গ্রাম বাংলার ঋণ তিনি চুকিয়ে গেছেন...।
লেখক : টেলিভিশন সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/এএসএম