পার্বত্য শান্তিচুক্তি : পাহাড়ি-বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে
২৫ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতের সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যেই শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। যে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্ট দু’দশকের বেশি সময় ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটে। ১৯৭০ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ওই এলাকার ভূ-বৈচিত্র্য, নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং সেখানে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের বিষয়ে জানার সুযোগ হয় শেখ হাসিনার। যা তাঁকে ওই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে কার্যক্রম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। এজন্য শান্তির অগ্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়নে সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কেবল ভূমি সংস্কার ব্যতীত পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সেনা ক্যাম্পগুলোর অধিকাংশই তুলে নেয়া হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের চারটি জায়গায় কেবল সেনাবাহিনীর চারটি ব্রিগেড থাকবে, বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে সব সরিয়ে নেয়া হবে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ আরও সুন্দরভাবে বসবাস করবেন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক আরও উন্নয়ন হবে- সেই লক্ষ্য নিয়েই সরকার ক্ষমতার ১৬ বছর কাজ করেছে। পাহাড়ের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইন সংশোধনের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ভূমি সংস্কার কমিশন বার বার গঠন করা হচ্ছে। কিন্তু এই কমিশনের কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে না। সরকার ভূমি সংস্কারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন একাধিকবার গঠন করলেও কমিশনের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোয়নি। কারণ সেখানে কিছুটা অবিশ্বাস এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন-২০০১-এর কতিপয় সংশোধনীর দাবি মেনে নেওয়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। প্রথম থেকেই বিএনপি পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিল। পার্বত্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে যখন অস্ত্র সমর্পণের আয়োজন করা হয়, তখন বিএনপি হরতাল ডেকে বলেছিল অস্ত্র সমর্পণ করা যাবে না। খালেদা জিয়া’র মন্তব্য ছিল, এই চুক্তি হলে ফেনী থেকে পুরো পার্বত্যাঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু সেসব কথা অসার প্রমাণিত হয়েছে। বরং শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সুসম্পর্ক এবং সৌহার্দ্য বিরাজ করছে।
২.
দেশের ভেতর থেকে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা হলেও ওই চুক্তির কারণে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং শেখ হাসিনা সরকার ওই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ খাত এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আসলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উপজাতি ও জুম্ম জনগোষ্ঠীর জাতীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব স্পষ্ট করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর সেই সময়কার আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পও বৃদ্ধি করেনি। বর্তমানেও চলমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বরং চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতে ইউপিডিএফ ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড- ও সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করছে। আবার তাদের রুখতে অন্যেরা অস্ত্র ধরেছে। অথচ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। একসময় বিভিন্ন দলের ভেতর কোন্দল এবং বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেওয়ায় চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। কিন্তু তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে সামনে রেখে সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবনে অভ্যস্ত বিচিত্র দলের কর্মীরা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাঝে-মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যার এখন পর্যন্ত সমাধান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি বাঙালিদের প্রতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিরা সদয় দৃষ্টি দেবে- এ প্রত্যাশাও রয়েছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের জনশক্তির।
উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা ইঞ্জিনিয়ার কনষ্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নসমূহ পার্বত্য এলাকায় সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৮ কি.মি. রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নির্মাণ করেছে প্রায় ৩০০০ কি.মি. রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থল বন্দর নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে দেশি এবং বিদেশি এনজিওসমূহের কার্যক্রম, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পার্বত্যাঞ্চলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ সড়ক, অরক্ষিত সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্যাঞ্চলে মোতায়নরত সেনাবাহিনীকে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় ৫০ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৩০ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা, ৯ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং এক হাজারের বেশি প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৭০০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া ব্যাপকভাবে লেগেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিলো না। সরকার ২০১৭ সালে সেখানে ১টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছে। আশির দশকে যেখানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি সেটা এখন ৪৭৯টি, প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.৬২ শতাংশে এ পৌঁছেছে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার ৫৯.৮২ শতাংশ সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩%। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে ৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে কোনো খেলার মাঠ ছিলো না বর্তমানে সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এককালের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল বলেই। অর্থাৎ শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক এসব উন্নয়ন চিত্রে।
৩.
মূলত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন। এ কারণে শেখ হাসিনার ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তিও ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য স্বীকৃতি। চুক্তির পর পুরো পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যার কিছু বিবরণ আগের অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে। গত ২৪ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ করা গেছে। অন্যদিকে গত ১২ বছর যাবৎ একটানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মধ্যে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিজ নিজ ধর্ম পালনে উৎসাহী করেছেন। এজন্য উপজাতিরা তাঁর কাছে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে- এটাই স্বাভাবিক। কয়েক বছর আগে কক্সবাজার জেলার রামুসহ টেকনাফ, পটিয়া ও উখিয়ায় দুষ্কৃতকারীরা দল বেঁধে বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটালে তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তিনি; ঘটনার পর নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। পাহাড়ি-বাঙালির সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির বন্ধন হোক পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম অনুধ্যান- এই প্রত্যাশা সকলের।
লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
এইচআর/এএসএম