তেলের গাড়ি, গ্যাসের গাড়ি এবং পরিবহনদস্যু
ইয়াহিয়া নয়ন
গণপরিবহন নিয়ে লিখতে বা আলোচনা করতে আমার মত অনেকেরই ভালো লাগে না। তারপরও আমরা যারা নিত্যদিন গণপরিবহনে চলাচল করি তাদের কাছে এটাই আলোচনার বড় বিষয়। গত সপ্তাহে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহন থেকে চলন্ত অবস্থায় দুজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় একজন মারা গেছেন, অপরজন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। গণপরিবহনের দস্যুদের হাত থেকে আমরা কবে রেহাই পাবো? এটা সবার কাছে একটা বড় প্রশ্ন।
চট্টগ্রামে বর্ধিত ভাড়া নিয়ে তর্কতর্কিতে এক যাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়েছেন চালকের সহকারী। ওই যাত্রীর নাম আবদুল হামিদ (৫১)। ১২ নভেম্বর রাতে এ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার লালখান বাজার এলাকার ইস্পাহানি মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। এতে ওই বাসযাত্রী আহত হন। এ ঘটনায় বাসচালক ও তার সহকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন চালক মো. হাসান (২৯) ও সহকারী মো. আশরাফ (১৮)। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর বাসে ভাড়া যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে বাড়তি নেওয়ায় প্রতিদিনই যাত্রীদের সঙ্গে বাসচালকের সহকারীর মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র বলেছে, বহদ্দারহাট থেকে পতেঙ্গাগামী ১০ নম্বর (চট্টমেট্রো জ-১১-১৮৭২) বাসে দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে উঠেছিলেন আবদুল হামিদ। সেখান থেকে লালখান বাজার যাওয়ার জন্য চালকের সহকারীকে ৫ টাকা ভাড়া দেন। কিন্তু নতুন বর্ধিত ভাড়ার দোহাই দিয়ে সহকারীর দাবি ছিল ৮ টাকা। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে বাসটি লালখান বাজার পৌঁছালে আবদুল হামিদকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। পরে তাকে স্থানীয়রা আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
যাত্রীকে ফেলে দেওয়ার পর অন্য যাত্রীরা বাসটি টাইগারপাস মোড়ে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ চালকসহ বাসটি আটক করে। এ সময় চালকের সহকারী পালিয়ে যায়। পরে অভিযান চালিয়ে সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় আবদুল হামিদ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। মামলায় কি হবে তা আমরা সবাই জানি। আহত লোকটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে কি না, আমরা কেউ তা জানি না।
এর আগে ৯ নভেম্বর রাজধানীতে ঘটে আরেক ঘটনা। রাইদা পরিবহনের একটি বাস থেকে ১০ বছরের এক মেয়ে শিশুকে ফেলে হত্যার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। নিহত শিশুটির নাম মরিয়ম আক্তার। গত ৯ নভেম্বর সকালে রাজধানীর ভাটারার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে তাকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- রাইদা পরিবহনের চালক রাজু মিয়া ও তার সহযোগী ইমরান হোসেন।
নিহত মেয়েটি ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। ঘটনার দিন সে সাহায্য চাইতে বাসটিতে উঠেছিল। হেলপার এ সময় তাকে বলে, এটা গেটলক বাস। এই বলে বাসের গেট খুলে চলন্ত বাস থেকে মরিয়মকে ফেলে দেওয়া হয়। এতে গুরুতর আহত অবস্থায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শিশুটির বাবা রনি মিয়া জানতে পারেন ভাটারা এলাকায় একটি মেয়ে শিশুর মরদেহ পাওয়া গেছে। ওইদিন বিকেলে তিনি মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করেন। পরে এ ঘটনায় রাতেই অজ্ঞাত গাড়িচালককে আসামি করে মামলা করেন তিনি। পরে র্যাব এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। এ সময় র্যাব ঘটনাস্থল ও আশপাশের প্রায় ৫০টির বেশি সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। এরপরই শিশুটির মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘটন হয়।
নিহত মরিয়ম ২০১৯ সালে স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তবে অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সে অর্থসহায়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুড়িল ও আশপাশের এলাকায় ঘোরাঘুরি করতো। ঘটনার দিন সকালে মরিয়ম বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পথচারী ও বাস যাত্রীদের কাছে ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাচ্ছিল।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ড্রাইভার রাজু মিয়া এবং হেলপার ইমরান হোসেন প্রতিদিনের মতো রাইদা পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা-মেট্রো-ব-১৪-৯০২২) নিয়ে পোস্তগোলা থেকে দিয়াবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সকালে যানবাহন ও যাত্রী কম থাকায় তারা দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। বাসটি যমুনা ফিউচার পার্কে পৌঁছালে মরিয়ম যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাইতে গাড়িতে ওঠে। এ সময় হেলপার ইমরান হোসেন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছিল। ইমরান তখন চালককে বলে, একজন ছিন্নমূল পথশিশু গাড়িতে উঠে অর্থসাহায্য চাচ্ছে। তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে সে রাজুকে গাড়ির গতি কমাতে বলে। এ সময় মরিয়মকে দরজার কাছে গিয়ে নেমে যেতে বলা হয়। চালক রাজু কিছু দূর না যেতেই আবার থামতে বলায় বিরক্ত হয়ে বাসের গতি হালকা কমিয়ে, মরিয়মকে তাড়াতাড়ি নামতে বলে। মরিয়ম তাড়াহুড়ো করে নামার সময় হঠাৎ চালক জোরে গাড়ি চালানো শুরু করে। এতে মরিয়ম বাসের দরজা থেকে ছিঁটকে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হয় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে চালক গাড়ি না থামিয়ে দ্রুতবেগে দিয়াবাড়ির দিকে চলে যায়। এরপর পোস্তগোলায় হাসনাবাদের একটি বাস ডিপোতে গাড়িটি রেখে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয়টি কাউকে না বলে আত্মগোপনে চলে যায়। নিহত মরিয়ম বাস থেকে নামার সময় বাসের গতি ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এতে সে বাস থেকে রাস্তায় পড়ে মারা যায়।
প্রতিদিন সারাদেশেই গণপরিবহনে যাত্রীদের সাথে চালক-হেলপারদের ঝগড়া চলছে। নতুন বর্ধিত ভাড়া আসলে কতো, অধিকাংশ চালক-হেলপার তা জানেই না। এরপর তেলের গাড়ি আর গ্যাসের গাড়ির গলদ তো আছেই। কিন্তু সবকিছুর পরে চলন্ত বাস থেকে যারা যাত্রীদের ফেলে হত্যা এবং আহত করছে,তাদের আমরা দস্যু ছাড়া আর কি বলবো? সভ্য দেশে নগর-মহানগরে প্রকাশ্যে এই দস্যুতা আর কত কাল চলবে?
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম