তিনি আছেন আমাদের হৃদয়ে
স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) এম সাদরুল আহমেদ খান
২০০৯ সালের পিলখানার বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরপরই আমার ডেপুটেশন হয় জাতীয় সংসদে। প্রথম দিনে যোগদানের পর পরিচয় পর্ব সারলাম স্পিকার আব্দুল হামিদের সাথে (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি)। বৈঠক শেষে চা খাওয়ার পরে তিনি বলেন, “সবুজ ভাইকে নিয়ে আহেন”। একটু ভাবনায় পড়লাম কে তিনি? পরে চিনলাম সবুজ ভাই হচ্ছেন কর্নেল (অব.) শওকত আলী, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) তার মৃত্যুবার্ষিকী।
নবম সংসদে ডেপুটি স্পিকার মহোদয়ের সাথে অনেক কাজ করেছি, রয়েছে অনেক স্মৃতি। He was an officer and a Gentleman। তিনি ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি। তিনিই সম্ভবত একমাত্র সামরিক কর্মকর্তা যিনি দেশপ্রেমের জন্য দু’দুবার চাকরিচ্যুত হন। স্বাধীনতার আগে প্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে আর স্বাধীনতার পরে নিজ হাতে গড়া নিজের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে। ’৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী আমলা সবাই যখন মোশতাক-জিয়ার সরকারকে প্রকাশ্য ও মৌন সম্মতি দেয় তখন বেঁকে বসা কর্নেল শওকত আলী চাকরি হারালেন।
অদম্য মনোবল আর সাহস ছিল তার, যাকে ভালবাসতেন মন থেকে আর সমালোচনা করতেন মুখের উপর। ১৯৭৯ এর নির্বাচনে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। সে সময় আমাদের কুলাউড়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জব্বার এমপি এর সাথে শওকত স্যার এর সখ্য গড়ে উঠে। আমার বাবা আব্দুল লতিফ খান সে সময় কুলাউড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন বিধায় তার সাথেও কর্নেল (অব) শওকতের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ পরিচয় হয় যা পরবর্তীতে বন্ধুত্বের সম্পর্কে পরিণত হয়। সে কারণেই হয়তো কর্নেল (অব.) শওকত স্যার আমাকে অনেক স্নেহ করতেন এবং সব সময় Skills Development এর উপদেশ দিতেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতি অনেক বৈচিথ্য্যময়। এখানে রাজনৈতিক কর্মী ছাড়াও আমলা, ব্যবসায়ী আইনজ্ঞ বিচারকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের বিচরণ। সামরিক বাহিনীর পেশাদার লোকের সংখ্যাও কম নয়। এখানে মজার বিষয় সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ সামরিক কায়দায় রাজনৈতিক দল চালান, আবার কেউ কেউ নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলে বেসামরিক ব্যক্তিত্বে রুপান্তরিত করেন। কিন্তু কর্নেল (অব.) শওকত আলী ছিলেন ভারসাম্য মিশ্রণ বা Balance Mixed। তার অফিস এডমিনিস্ট্রেশন, প্রটোকল সাজসজ্জা Turn out Bearing ছিল দক্ষ অফিসারের মতো। অপরদিকে এলাকার মানুষের সাথে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা সাক্ষাৎকার করতেন। প্রতিটি ছুটির দিনে চলে যেতেন মাটির টানে নিজ এলাকা নড়িয়া, শরিয়তপুর।
কর্নেল (অব.) শওকত আলী স্যার আমাকে অনেক জীবনমুখী শিক্ষা দিয়েছেন তার কয়েকটি তুলে ধরছি-
১। তিনি পোশাক পরিচ্ছদ Turnont Bearing এর প্রতি জোর দিয়ে বলতেন Start the day with task completed তার মানে যথার্থ পোশাক, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে দিন শুরু করবে, দেখবে দিনটি সফল হবে। আর যদি দিনটি বিফলে যায় তাও সবাই জানবে a beautiful mind in a beautiful body । আর মার্জিত পোশাকে নিজেকে পরিবেশন করাও একটি সফলতা।
২। তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল মানুষ, আর সবসময় আমাকে প্রশ্ন করতেন Who is your best friend? তিনি বলতেন, প্রত্যেকের জীবনে ভাল বন্ধু দরকার যে সুখ, দুঃখে সব সময় কাছে থাকবে। প্রশংসা করবে আবার সমালোচনাও করবে। You alone can’t change the world, find good friend who will help you no matter what.
৩। তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের সাথে নম্র, ভদ্র, আচরণ করতেন। তিনি বলতেন- যদি কারো মন জয় করতে চাও মানুষকে তার ধর্ম ডিগ্রি সম্পদ বা কোন সূচকে পরিমাপ না করে মনের বিশালতার উপর বিচার করবে। তবে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি তিনি ছিলেন সর্বদাই সোচ্চার।
৪। তিনি সব সময় বলতেন Move on। কোন অপ্রাপ্তি কোন ব্যথা, কোন বাধা তাকে থামাতে পারত না। তিনি বাংলাদেশের জন্যই পাকিস্থান সেনা বাহিনীর চাকরি হারালেন আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তাকে চাকরিচ্যুৎ করল। তিনি বলতেন জীবনে যত ভাল প্রস্তুতি নাও না কেন প্রতিকূল পরিস্থিতি আসতেই পারে, জীবনের গতি পথ উল্টে যেতেই পারে কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না। নিজ লক্ষে এগিয়ে যেতে হবে, হতাশার কোন স্থান নাই।
৫। তিনি বলতেন, if you want to change the world, don’t be afraid of fail. Failure is part of life and it makes you stronger and experienced.
৬। তিনি সব সময় বলতেন There will be problems in the world. If you want to change the world never walk away সমস্যা কে অনুধাবন কর, সমাধান খোঁজার চেষ্টা কর। কোন সমস্যাই সমাধানের বাহিরে নয়,Nothing is Impossible.
৭। কর্নেল (অব.) শওকত আলী সংসদ লাইব্রেরির কমিটির সভাপতি ছিলেন। বই পড়া যেমন তার নেশা ছিল তেমনি আমাকেও বিভিন্ন বই পড়তে বলতেন। তিনি বলতেন- Make books your best friend. If you want to change the world, knowledge is the key.
কর্নেল (অব.) শওকত আলীর মৃত্যূবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র্র শ্রদ্ধা। সেই সাথে তার দেয়া শিক্ষা মনে ধারণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছি। তিনি চলে গিয়েও আছেন আমাদেরই মাঝে। “Heroes live forever”।
লেখক: সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট- এট- আমর্স এবং সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
এইচআর/এএসএম