রেইনট্রি হোটেলে কেউ যায়ইনি!
অপরাধের মধ্যে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধর্ষণ। খুন হলে তো ভিকটিমের জীবন শেষ, পরবর্তী প্রতিক্রিয়াটা তিনি জানতেই পারেন না। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্কের যে ভয়াবহতা, তা একজন ভিকটিমকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। ধর্ষণের যে ভয়ঙ্কর ট্রমা তা থেকে আসলে একজন ভিকটিম কখনোই বেরোতে পারেন না। বাংলাদেশে ধর্ষণ বলতে আমরা সাধারণত নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়কে ধরে নেই। তবে ইদানীং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে মাদরাসায় ছেলেশিশুদের ধর্ষণের ঘটনাও বাড়ছে। অবশ্য গণমাধ্যম ছেলেশিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে কেন জানি না ‘বলাৎকার’ শব্দটি ব্যবহার করে। ভিকটিম নারী হোক, পুরুষ হোক, শিশু হোক, উভলিঙ্গ হোক; ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক মানেই ধর্ষণ, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
ধর্ষণের ব্যাপারটি ছোট করে বললে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও সাথে যৌন সস্পর্ক। ভিকটিম যেই হোক, সম্মতি ছাড়া কিছু করা যাবে না। বন্ধু, পূর্বপরিচিত, এমনকি স্ত্রীর সাথেও সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক করা অপরাধ। এমনকি পেশাদার যৌনকর্মীও যদি যে কোনো পর্যায়ে অসম্মতি জানায়, তাও অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ভারতের বহুল আলোচিত ‘পিঙ্ক’ সিনেমায় আইনজীবীর চরিত্রে অভিনয় করা অমিতাভ বচ্চন এক আর্গুমেন্টে মামলা জিতে নিয়েছিলেন- নো মিন্স নো, না মানে না।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনার পর ‘না মানে না’ যুক্তিটি আলোচনায় এসেছিল। সেই ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পর সেই মামলার রায় আরও বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। এই মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে মূল অভিযুক্ত ছিল আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ। মূল আসামি যেহেতু টাকার কুমিরের ছেলে তাই ঘটনার পর থেকেই এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ছিল। পাঁচ বছর পর সে আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।
গত ১১ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার যে রায় দিয়েছেন, তার দুটি দিক আছে। একটি হলো সব আসামিই বেকসুর খালাস। তবে তার চেয়েও বড় আলোচনা রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে। আগে রায়ের কথা বলে নেই। আসামিপক্ষ এরই মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমিও মনে করি মামলার রায় ঠিক হয়নি। তবে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে বলেই মামলাটি সঠিক হবে, এমন দাবি আমি করছি না। হতে পারতো, তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরম্বরা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ, মিডিয়ার অনুসন্ধান সব মিলে মামলাটি বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে করছেন সবাই। তবে সবার মনে করা দিয়ে তো আদালত বিচার করবেন না। তিনি বিচার করবেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ, তদন্তের ভিত্তিতে। কিন্তু বিচারক কামরুন্নাহার যেভাবে সব দায় তদন্ত কর্মকর্তার ওপর চাপালেন, যে খোড়া যুক্তিতে পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দিলেন; তাতে তাকে বিচারক নয়, আসামিপক্ষের আইনজীবী মনে হয়েছে। তদন্তে দুর্বলতা থাকলে তিনি পুনঃতদন্তের আদেশ দিতে পারতেন। তা না করে তিনি ভিকটিমদের দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম, আপিলে প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে।
তবে রায়ের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর রায়ের পর্যবেক্ষণ, যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, তাকে কারণ দর্শাতে বলা হবে। বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের এই দ্রুত পদক্ষেপ আমাদের আশ্বস্ত করে। কারণ কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণ ধর্ষণের বিচার সম্পর্কেই সমাজে ভুল বার্তা দিতে পারতো। কামরুন্নহারের পর্যবেক্ষণ দেখে মনে হয়েছে, বিচারব্যবস্থা তো বটেই; নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকার, নারী অধিকার, সংবিধান- কোনো কিছু সম্পর্কেই তার কোনো ধারণা নেই। তিনি নিজে একজন নারী হলেও নারী সম্পর্কে তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, তার মাথাভর্তি পুরুষতান্ত্রিকতার জঞ্জাল। এমন একজন অসংবেদনশীল মানুষ এতদিন বিচারকের আসনে বসেছিলেন, এটাই ভয়ঙ্কর সংবাদ। এটা আলোচিত বলে, জানাজানি হয়েছে। না জানি এর আগে আরও কত বিচারপ্রার্থী কামরুন্নাহারের অন্যায়ের শিকার হয়েছেন।
ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কামরুন্নাহার। পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ৭২ ঘণ্টা পর যেন কোনো ধর্ষণ মামলা নেয়া না হয়। কী ভয়ঙ্কর নির্দেশনা! এমনিতেই বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার চাওয়া নিয়ে অনেক ট্যাবু আছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ধর্ষণের ঘটনার মাত্র ২৩ ভাগ থানা-আদালত পর্যন্ত যায়। ধর্ষণের পর ভিকটিম প্রথম প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করে সব প্রমাণ মুছে ফেলে। আর সমাজ, এমনকি নিজের পরিবারও ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করে রাখতে চায়। ধর্ষিতার কোনো অপরাধ না থাকলেও তাকেই সমাজে হেয় করা হয়, ধর্ষিতাকে কেউ বিয়ে করে না, এমনকি ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ের মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটে। ধর্ষণের ট্রমা কাটতে অনেক সময় লাগে, থানায় যাবে কি না সে সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক সময় লাগতে পারে। আর সাহস করে বিচার চাইতে গেলেও ধর্ষিতা থানা, মেডিকেল, আদালতে এক ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ধর্ষণের যেহেতু সাক্ষী থাকে না, তাই প্রমাণ করা কঠিন। কঠিন বলেই ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই আড়ালে থেকে যায়। ধর্ষিতা যাতে ন্যায়বিচার পায়, সেজন্য তদন্ত প্রক্রিয়া, হাসপাতালে পরীক্ষা, আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সংবেদনশীলতা দরকার; সেখানে কামরুন্নাহারের মতো অসংবেদনশীল মানুষ ধর্ষিতাকে বিচার চাইতে নিরুৎসাহিত করছেন। তার জানা উচিত ছিল, ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ৪৫ বছর পর; সেখানে ধর্ষণের মামলা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করার নির্দেশ ছিল হাস্যকর। এটা ঠিক, যত দেরি হবে, অপরাধ প্রমাণ তত কঠিন হবে। কিন্তু ধর্ষণের বিচার অন্য অপরাধের মতো নয়। হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বলা যাবে না বা আসামি খালাস পেতে পারে না। ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ভিত্তিতেই আসামিকে সাজা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কামরুন্নাহার বোধহয় হাইকোর্টের এ নির্দেশনা সম্পর্কে জানতেনই না। তিনি মেডিকেল রিপোর্ট ধরে এ মামলায় আসামিদের নির্দোষ বলে দিয়েছেন।
এ মামলার মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘কোনো ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স (জোরপূর্বক যৌন সঙ্গম) আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তারা যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত।’ আর এই মেডিকেল রিপোর্টের বরাত দিয়ে বিচারক বলেছেন, ‘এতে প্রমাণিত হয়, তারা রেগুলার শারীরিক সম্পর্ক পারফর্ম করে। তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে।’ নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক করলেই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে? তাদের ধর্ষণ করা জায়েজ হয়ে যাবে। রায়ে কামরুন্নাহার বলেছেন, ‘একসঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় ড্যান্স করলেন, পরে এক বিছানায় চারজন মিলে শুয়ে থাকলেন, এখানে ধর্ষণ কীভাবে হলো? তারা ছিলেন উইলিংলি পার্টনার (স্বেচ্ছায় শয্যাসঙ্গী)। উত্তেজনাবশত শারীরিক সম্পর্ক করলে সেটা ধর্ষণ হয় কীভাবে? সেখানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, কিন্তু সেটা ধর্ষণ নয়। আর ওই হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না বলে কর্মচারীরা সাক্ষ্যে বলেন। সুতরাং অস্ত্রের মুখে কীভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটল?’ রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার পর অনেকেই বলছিলেন, মেয়ে দুটি হোটেলে গেলো কেন, মদ খেলো কেন, নাচলো কেন? তার মানে তাদের চরিত্র খারাপ। তার মানে তাদের ধর্ষণ করা ভুল হয়নি। কী বিস্ময়কর, সেই একই সুর বিচারকের কণ্ঠেও। কামরুন্নাহারের দায়িত্ব ছিল বিচার করা, কারও চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেয়া নয়।
কোনো প্রমাণ ছাড়াই চার্জশিট দিয়ে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করায় তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেছেন বিচারক কামরুন্নাহার। তার অভিযোগ, অন্য কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমার তো সন্দেহ বিচারকই কোনো পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ‘ঐতিহাসিক’ রায় দিয়েছেন।
আইন তার নিজের গতিতে চলে, এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছু নেই। অর্থ, প্রভাব, ক্ষমতা- আইনকে প্রভাবিত করার মতো অনেক উপাদানই আছে। কে কীভাবে প্রভাবিত হয় কে জানে। তবে আইন সম্পর্কে সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন আল আব্বাসের কাছ থেকে শোনা একটি কথা বলি- যখন গরিবে গরিবে আইনি লড়াই হয়, তখন দুই পক্ষই নাই হয়ে যায়। যখন ধনী আর গরিবে আইনি লড়াই হয়, তখন গরিব নাই হয়ে যায়। আর যখন ধনীতে ধনীতে আইনি লড়াই হয়, তখন আইন নাই হয়ে যায়। রেইনট্রির ঘটনায় দুই দুর্বল ভিকটিমকে তো ‘চরিত্রহীন’ বলে নাই করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে; একইসঙ্গে নাই করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। তবে এখনও মানুষের শেষ ভরসা সুপ্রিম কোর্ট এই চেষ্টা রুখে দিয়েছেন। আশা করি উচ্চ আদালতে ভিকটিমরা ন্যায়বিচার পাবেন।
শুরুতে হিন্দি সিনেমা ‘পিঙ্ক’র কথা বলেছিলাম। বাংলাদেশে এমন একটা সিনেমা হয় না কখনো। বিচারব্যবস্থা নিয়ে আরেকটি হিন্দি সিনেমার কথা বলে লেখাটি শেষ করছি। ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’ নামে সিনেমাটিতে জেসিকা নামে এক তরুণী খুন হয়েছিল। কিন্তু রেইনট্রির মতো জেসিকার খুনিরাও প্রভাবশালী ছিল। তাই আদালতে তারা বেকসুর খালাস পেয়েছিল। অবশ্য পরে জেসিকার খুনিদের বিচার হয়েছিল। রেইনট্রির ঘটনায় বিচারক বলেছেন, ভিকটিমরা যে রেইনট্রি হোটেলে গিয়েছিল সেটাই তদন্তে প্রমাণ করা যায়নি। এখন বাংলাদেশের কেউ কি ‘রেইনট্রি হোটেলে কেউ যায়ইনি’ নামে একটা সিনেমা বানাতে পারেন?
১৪ নভেম্বর, ২০২১
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএননিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস