বিচারপতি তোমার বিচার
বাংলাদেশের ইতিহাসে তো প্রথমই, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল একটি ঘটনা ঘটেছে। কোনো দেশের প্রধান বিচারপতিকে ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের মামলায় চার বছর এবং সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন সে দেশের আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম ৯ নভেম্বর ২০২১ ঋণ জালিয়াতির মামলায় চার বছর এবং অর্থপাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি একসঙ্গে এই দুই মামলার পৃথক দণ্ড ভোগ করবেন। অর্থাৎ সাত বছর জেল খাটতে হবে তাকে। আত্মসমর্পণ করলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও সুযোগ পাবেন তিনি। রায়ে সিনহাকে ৪৫ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে, যা অনাদায়ে কারাদণ্ড আরও ছয় মাস বাড়বে। এ ছাড়া তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অবরুদ্ধ থাকা ৭৮ লাখ টাকা বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক বা বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ১১ জন আসামির আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। বাকি দুইজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক উল্লেখ করেছেন, ফারমার্স ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা অবৈধভাবে সিনহার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল।
রায়ে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীমকে দেওয়া হয়েছে চার বছরের কারাদণ্ড। একইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী), ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট গাজী সালাহউদ্দিন, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী এবং টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়কে দেওয়া হয়েছে তিন বছর করে কারাদণ্ড।
বিচারপতি সিনহা একজন দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতি ছিলেন এটা দেশের প্রায় সবাই জানতেন। এখন সেটা আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হলো। অবশ্য সিনহাকে জেলে দেওয়ার জন্য পাওয়া যাবে কিনা বলা যাচ্ছে না। আর তিনি এসে আত্মপমর্পণ করবেন- এটা বোধহয় দুরাশা। কারণ ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তিনি হাজির হননি। তিনি পালিয়ে আছেন কানাডা।
বিচারপতি সিনহা কানাডা যাওয়ার আগে ছিলেন আমেরিকায়। তারও আগে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে লম্বা ছুটি নিয়ে প্রথমে অস্ট্রেলিয়া যান, সেখান থেকে চিকিৎসার নাম করে যান সিঙ্গাপুরে। ছুটি শেষ হওয়ায় তিনি দেশে ফিরবেন কি-না সে নিয়ে আলোচনা তখন জানা গেল সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ভারতীয় মিডিয়াকে দিয়ে তিনি সংখ্যালঘু কার্ড খেলেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়েছেন। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছেন দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি হিন্দু মৌলবাদীদের সহায়তায়। ভারতীয় মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
আমেরিকায় বসেও একই চেষ্টা করেছেন কিন্তু পাত্তা পাননি। বিদেশে বসে সিনহা নিজের জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ নামে মনগড়া কাহিনীনির্ভর একটি বইও লেখেন, যেটা হালকা বিতর্ক সৃষ্টি করলেও পাঠক পায়নি।
সিনহা প্রধান বিচারপতি থেকে অপসারিত হতে পারেন বুঝতে পেরে সরকারের সঙ্গে ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ খেলতে চেয়েছেন শেষ বেলায়। অথচ দুর্ভাগ্য হচ্ছে যোগ্যতা না থাকলেও আওয়ামী লীগ বাইরের বিশ্ব আর সংখ্যালঘুদের দেখানোর জন্য সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করেছিল। হিন্দু (মনিপুরী নৃগোষ্ঠীর সদস্য) বলেই সরকার ভাবতে পারেনি তিনি স্বাধীনতাবিরোধী হতে পারেন। সিনহা নিজেই যখন স্বীকার করলেন তিনি ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন তখন সরকারের করার কিছু ছিল না।
খবর বেরিয়েছিল, ২০০৮ সালে হাই কোর্টের বিচারপতি থাকাকালে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে বিচার বিক্রি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ ছিল। তখন ২০০৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি পদত্যাগ করেননি। বরঞ্চ তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
একজন বিচারপতি যিনি বিচার বিক্রি করার অভিযোগে অভিযুক্ত, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত- তার তদন্ত করে বিচার সোপর্দ করার পরিবর্তে তাকে অ্যাপেক্স কোর্টে কারা নিয়োগ দিয়েছিলেন? এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তার নিয়োগের ব্যাপারে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে জাতির অবগত হওয়ার দরকার আছে। কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো তারও ব্যাখ্যা দেওয়া সরকারের উচিৎ।
সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করার প্রথম প্রতিদান হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে গ্রিকমূর্তি স্থাপন করে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু কি তাই, সিনহার চালে সরকারের সাপোর্টার অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল মূর্তি থাকা না থাকার প্রশ্নে। কেউ এটিকে দেখলো নান্দনিকতার দিক থেকে কেউ দেখলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। আলোচনায় উঠে এলো মৃতপ্রায় হেফাজত।
১৬তম সংবিধান সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে সিনহাকে বিরোধীদল বীরপুরুষ হিসেবে পেয়েছিল, যদিও সে রায়ের অবজারভেশনে জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে অবৈধ, বিএনপি অবৈধ সন্তান। আর সিনহার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ ছিল, সিনহার ষোড়শ সংশোধনীর রায়টা একটা ষড়যন্ত্র। কারণ তিনি রায়ে যে অবজারভেশন দিয়েছেন, সুস্থ মস্তিষ্কে অবজারভেশনগুলো পড়লে মনে হবে যে, এই প্রজাতন্ত্রটি অকার্যকর হয়ে গেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দিয়ে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ ঘটিয়ে কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। আইনমন্ত্রীর উচিত ছিল এটা নিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করা।
বিচারপতি সিনহা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য যত্রতত্র বলা শুরু করলেন, বিচার বিভাগের কোনো স্বাধীনতা নেই। তিনি যে কোনো রাজনৈতিক নেতার চেয়েও প্রকাশ্যে বেশি বক্তব্য প্রদান করেছেন। বাংলাদেশে সিনহা তো প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন না, শেষ প্রধান বিচারপতিও নন। আমরা বহু প্রধান বিচারপতি দেখেছি। তার মতো কেউ প্রকাশ্যে এত বক্তৃতাবাজি করে বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করেননি।
একজন প্রধান বিচারপতি বিচারাধীন মামলার আসামি যার ট্রায়াল কোর্টে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিটিং করেন কিভাবে? এটা কি মিথ্যা ছিল? কথাটা তো তিনি নিজে স্বীকারও করেছেন। এখানে একজন বিচারকের নীতি নৈতিকতা কোথায়! তার দুর্নীতি অবহিত হয়ে সহকর্মীরা যখন তার বেঞ্চে বসতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল তখন সিনহার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলে অনেক ধূম্রজাল সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে বিরোধী দলের সহানুভূতিও আদায় করতে পেরেছিলেন।
সিনহার বাড়ম্বর ছিল তার দুর্নীতি ঢাকার অপ-কৌশল। তার কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে বিচার বিক্রি করে অবাধে টাকা উপার্জন। সিনহার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা একজন অসাধু বিচারপতির হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল এবং সর্বশেষ তার সাজার দণ্ড বিচার বিভাগকে আরও মর্যাদার আসনে নিয়ে গেল।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]
এইচআর/জিকেএস