৭ নভেম্বরের উপলব্ধি
৭ নভেম্বর আমার কাছে বরাবরই একটি বিতর্কিত দিন। এই দিনটি সম্বন্ধে আমার ধারণা একই সাথে স্বচ্ছ এবং অস্বচ্ছ। ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর আমার হিসেবে কমপক্ষে তিনটি ভিন্ন ধারার গোষ্ঠি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। এটি ছিল পুরোপুরি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বিশৃঙ্খল একটি সশস্ত্র বাহিনীর ভেঙেপড়া চেইন অব কমান্ডের লজ্জাজনক বহিঃপ্রকাশ। এখানে আর যাই হোক সাধারণ মানুষের একবিন্দুও সংশ্লিষ্টতা যে ছিল না, এটুকু আমার কাছে একেবারেই স্বচ্ছ।
আমার কাছে যা অস্বচ্ছ তা হলো এই রক্তক্ষয়ী জুয়া খেলায় সেদিন যদি জিয়া না জিতে অন্য কোনো পক্ষ জিততো, তাহলে বাংলাদেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? আমার ধারণা জিয়ার হাতে বাংলাদেশ যে পাগাড়ে গিয়ে পড়েছিল, এই জুয়ায় অন্য কেউ জিতলেও বাংলাদেশটা সেই পাগাড়ে গিয়েই পড়তো। কারণ যারা সেদিন পরাজিত হয়েছিলেন তারা কেউই আর যাই হোক বাংলাদেশটাকে ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় তাগিদ থেকে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত হননি।
৭ নভেম্বর সম্বন্ধে আমার ধারণা আরেকটি জায়গায় খুবই স্বচ্ছ। তাহলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর যে প্রক্রিয়াটির সূচনা, তারই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয়েছিল ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড আর বাংলাদেশকে পাকিস্তানকরণের চূড়ান্ত প্রক্রিয়াটির সূচনা হয়েছিল ৭ নভেম্বর। এদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী খুনি মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানফেরত বিভ্রান্ত সেনা সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন অসংখ্য-অজস্র মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক এবং এই যে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের সূচনা তা চালু ছিল ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত, যেদিন তার কৃত অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে বেঘোরে নিহত হন জেনারেল জিয়া।
একই সাথে জিয়ার সময়ে পাশাপাশি অব্যাহত ছিল রাজাকার তোষণ। জিয়ার শাসনে বাংলাদেশ পেয়েছে রাজাকার সাংসদ, দেশদ্রোহী মন্ত্রী আর মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। একাত্তরের বাঙালি হত্যাযজ্ঞের মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে একদিকে যেমন দেশে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল জিয়ার শাসনকালে, তেমনি জিয়ার মন্ত্রিসভায় গন্ধ ছড়িয়েছিল শাহ আজিজ, মাওলানা মান্নান আর আব্দুল আলিমের মতো ঘৃণ্য নরপশুগুলো।
বাংলাদেশকে শিকার হতে হয়েছিল রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ধর্ষণেরও। শুধু যে জয় বাংলা আর বাংলাদেশ বেতার রাতারাতি বদলে গিয়েছিল তাই নয়, ‘আবার তোরা মানুষ হ’র মতো চলচ্চিত্র সরিয়ে মূলধারায় চলে এসেছিল আবে হায়াত জাতীয় অদ্ভুতুরে সব চলচ্চিত্র, যেখানে কল্প রাজ্যের সব চরিত্রদের বানানো হয়েছিল আমাদের জাতীয় আইডল। অর্থনীতিও গিয়ে ঠেকেছিল ভাগারে। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৩৭০ ডলারের আশপাশে। জিয়ার শাসনে ১৯৭৭-এ এটি নেমে আসে ১২০ ডলারের আশপাশে। বঙ্গবন্ধুর সময়কার সেই মাথাপিছু গড় আয় আরেকবার ছুঁতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে এত অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে অপঘাতে জেনারেল জিয়ার মৃত্যু হয় ১৯৮১-তে আর নিয়তির নির্মম পরিহাসে এর মাধ্যমেই তার এতসব অপরাধের দায়মুক্তি ঘটে। কারণ কি এক অদ্ভুত কারণে আইনশাস্ত্রে বলা আছে মৃত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা যাবে না। অথচ আইনের এই মারপ্যাঁচে এত বড় একজন অপরাধীর ছাড় পেয়ে যাওয়া মানে যে অসংখ্য-অজস্র নিরপরাধ ব্যক্তি আর তাদের পরিবারকে বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আর জাতিকে চিরতরে কলঙ্কিত করে রাখা তা কেন যেন বিজ্ঞ আইনজ্ঞদের বিবেচনায় আসেনি।
আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পর যদি এই অপরাধী জেনারেল জিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের উত্তরসূরিরা প্রশ্ন তোলে যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরসূরিরা টানা এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরও এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত না করা মানে হচ্ছে তারা আসলে কোন ধরনের কোন অপরাধই করেনি, তখন আমাদের উত্তরসূরিরা তাদের কি উত্তর দেবে?
ইতিহাসকে ইতিহাসের সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারার ব্যর্থতার জন্য ইতিহাস কি আমাদের কখনও ক্ষমা করবে? আজ আরেকটি ৭ নভেম্বরে দাঁড়িয়ে এখন সময় এসেছে এসব বিষয় মাথা ঘামানোর। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে ’৭৫-এর আগস্টের ১৫ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এদেশে সংগঠিত একের পর এক যত মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেসবের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করে জাতির ইতিহাসকে শুদ্ধ করা আর জাতিকে চিরতরে কলঙ্কমুক্ত করাটাই এখনকার ঐতিহাসিক বাস্তবতা। জেনারেল জিয়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার মূল কারিগর, এটাই ঐতিহাসিক সত্য আর এই সত্যটি নির্মোহভাবে প্রতিষ্ঠা করাটা এখন আমাদের অন্যতম জাতীয় কর্তব্য।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জেআইএম