অভিযোগের রাজনীতি: জনগণের কথা ভাবুন

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ০৭ নভেম্বর ২০২১

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও মন্দির ভাঙচুরের পরিকল্পনা করা হয়েছে গণভবন থেকে। সারা দেশে হামলার ঘটনায় যারা আটক হয়েছে সব ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতাকর্মী। সত্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় এখন পুলিশকে দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরে নির্যাতন করে মিথ্যা নাটক সাজানো হচ্ছে, যা মানুষ বিশ্বাস করে না।

ঠিক একই রকম বক্তব্য দিয়েছিল আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতারা। তারা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক পরিবেশের পরিকল্পনা করা হয়েছে বিএনপির প্রবাসী এক নেতার নির্দেশে। তিনি দেশের বর্তমান উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই মন্দিরে-পূজামন্ডপে পবিত্র কোরান রেখে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টা করছে।

বিএনপি, আওয়ামী লীগের বাইরে প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে যে সব বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তার সার মর্ম হলো সম্প্রীতি বিনষ্টের এই ঘটনার জন্য তারাই জড়িত যারা এ-থেকে ফায়দা লুটতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ চেতনাগতভাবে ও সাংস্কৃতিক চেতনায় অসাম্প্রদায়িক।

শত শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম বাস করে আসছে, সম্প্রীতি নষ্ট হয়নি বা এমন কোনো পরিস্থিতির জন্ম হয়নি। (রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জের ধরে উপমহাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ঘৃণার বিষ ছড়ালে পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে পরিণত হয়। সেটা ছিল দেশ বিভাগের সূত্র ধরে দেশান্তরী হওয়ার আশঙ্কায় এবং হিন্দু মুসলমানের ভেতরে অবিশ্বাস সৃষ্টির ফল ) যা আমাদের সহাবস্থানকে নস্যাৎ করেছে অনেকটাই। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, ওই সাম্প্রদায়িকতার মূলে ছিলো পলিটিক্যাল নেতৃত্ব ও তাদের অনৈতিক সিদ্ধান্ত। তার পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে।

আমরা এখন ২১ শতকের চারভাগের এক ভাগ সময় পার করতে চলেছি। এই অত্যাধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের শীর্ষদের্শে এসে যদি দেখি হিন্দুর পূজামন্ডপে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রাখা হয়েছে, সেটা কোনো ধর্মপ্রাণ করতে পারে না। তাহলে করেছে সেই জন, যার ভেতরে রয়েছে পলিটিক্যাল আধিপত্য বজায় রাখার অন্ধ নেশা। আর তাকে পরিচালনা করেছে রাজনৈতিক সত্তা, যা সাধারণ মানুষের নয়।

এই টোটাল রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে আছে কোটি কোটি মানুষ, যারা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাইরের সাধারণ মানুষ। এদেরকেই আমরা দেশের আসল মানুষ বা জনগণ বলি। এই জনগণের মৌলিক চিন্তা তার সারা বছরের খাদ্যশস্য উৎপাদন ও ব্যয় সংস্থানের চিন্তা। তাদের প্রতিবেশি হিন্দুর বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত করার মনও নেই মানসিকতাও পোষণ করে না তারা। আর সেই অবারিত সময় কোথায় তাদের?

রাজনীতিকদেরই রয়েছে অবারিত সময় ও সুযোগ রাজনৈতিক কর্ম-কৌশল প্রণয়নে এবং তা বাস্তবায়নে। সেই সব পরিকল্পনায় ‘জনগণ দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার হয়। কিন্তু জনগণ তার কিছুই জানে না। তারা রেডিও-টিভিতে আজকাল শোনেন রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ-উল্টো অভিযোগ। এই অভিযোগের বিপরীতে অভিযোগই এখনকার রাজনৈতিক ধারা। কোনো অপকর্ম বা সাংস্কৃতিক দুর্ঘটনা ঘটলেই এক দল আঙুল তোলে অন্য একটি দলের দিকে।

এই অভিযোগের রাজনীতি আমাদের সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসী বা ভিনদেশি সুযোগসন্ধানীরা সৃষ্টি করে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির, যা তাদের রচিত নীলনকশা বাস্তবায়ন সহজ হয়। আমাদের রাজনীতিকরা এ-সবই বোঝেন, কিন্তু ক্ষমতার লোভ তাদের এই রাজনৈতিক গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে দেয় না বা দিচ্ছে না। যেহেতু রাজনীতিকদের ‘সাফল্য’ কেবলমাত্র ক্ষমতার মসনদে পৗছানোর ইঁদুর দৌড়ে সীমাবদ্ধ, তাই রাজনৈতিক ধারা ওই পথেই নিজেদের কাজ সচল রাখে। এটা ক্ষমতাসীনরা বেশি বোঝেন। কারণ তারা চায় না ক্ষমতার মধু হারাতে। আর যারা ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ধ্যান, কোন পথে, কিভাবে ক্ষমতার মসনদের স্বাদ পাবো।

যারা প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল করেছেন, মানববন্ধন করেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। কারণ তারা কিন্তু সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার জন্য জনগণকে দুষছেন না, তারা দুষে চলেছেন সমাজের , রাজনীতির নেতাদের। তারা ক্ষুব্ধ হলেও, তাদের উত্তপ্ত বক্তৃতার ভাষা পরোক্ষধর্মী। আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন যে অটুট আছে, কোনো পক্ষই যে সংখ্যাগুরুদের ধুষছেন না, সেটা আমরা বুঝি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন এমন অসুস্থ চিন্তাকে ধারণ করছেন, সেটাই তারা বলতে চাইছেন। তার মানে রাজনীতিকদের শুদ্ধ, পরিশুদ্ধ হতে হবে।এটাই তাদের মূল বক্তব্য।
পরিশুদ্ধতা আসবে কী ভাবে?গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির আচার-আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার পদ্ধতি ত্যাগ করে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক সহমর্মিতার বোধন ঘটিয়ে ওই দোষারূপের পথ পরিত্যক্ত হতে পারে।এই যে দোষ ঢালছেন মুসলমানদের ওপর, যারা এই অপরাধে জড়িত নয় ঠিক, তবে মুসলমানের নামের ওপরে গিয়ে পড়ছে দোষের আপচ্ছায়া। ওই মানুষগুলো মুসলিম নাম ধারণ করলেও তারা মুসলিম শিক্ষা ও আচরণের অধীন নয়। তাই তারা মুসলমান নয়, সন্ত্রাসী। আর সন্ত্রাসীদের যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ছাতা দেয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত এই সম্প্রীতি নষ্টের প্রয়োজন হবেই। আর যদি সন্ত্রাসী মননের চর্চা বন্ধ হয়, তাহলে ওই পথ চিরদিনের জন্য পরিত্যক্ত হবে। আর যারা পূজামন্ডপ বা মন্দির ভেঙেছে, তারা অবশ্যই রাজনৈতিক এজেন্ট/কর্মী, কোনো ধর্মীয় সাধারন মানুষ তারা নন। অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মী আর সাধারণ মানুষ এক সমাজের মধ্যে বাস করলেও তাদের আইডেনটিটি ভিন্ন। অতএব কোনো ধর্মীয় মানুষের ওপর দোষ চাপানোর আগে বোঝা উচিত, কাদের ওপর সেই দোষ চাপানো হচ্ছে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই হীনতাই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার স্বরূপ উন্মোচন করে চলেছে। কোনো অপকর্ম হলেই ক্ষমতাসীন দল তার দায় বিরোধীদের কাঁধে চাপান। আবার একই কাজ করেন বিরোধী দল। এই রাজনৈতিক উতোরচাপান খেলা আর কতোকাল চলবে, সেটাই আমাদের জিজ্ঞাসা। এক আর যাই বলা হোক রাজনীতি বলে না, গণতান্ত্রিক রাজনীতি তো বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ড যে রকম দূরের অবস্থান, সেই রকম বহু দূরের পথ হয়ে উঠেছে। এটাও তো লজ্জার বিষয় রাজনীতিকদের জন্য। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের নিখিল মানবাধিকারের সব নর্মস পালন করে, লালন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমাদের দেশে তার উল্টোটাই ঘটে চলেছে। আমরা পুঁজির জগতে বাস করি, কিন্তু তার রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন-পালন করি না। পুঁজিকেও শিল্পের চালিকাশক্তিতে নিহিত করতে পারিনি। ফলে এখানকার শিল্প সেক্টরের মালিক-মোক্তারগণের একটা অংশ ঋণখেলাপ করতে ভালোবাসেন। কেউ কেউ সেই ঋণের টাকা পাচার করতেও ভালোবাসেন। গণতান্ত্রিক সরকার নেই বলে সেই লুটেরাদের শেকড়ের সন্ধান জানা সত্ত্বেও তাদের টিকিটি ছুঁতে পারেন না সরকার। এটা যে চরমভাবে সাংঘর্ষিক, সেটাইও তারা তলিয়ে দেখেছেন সরকার।

পুঁজির বিকাশ সাধন করতে চাইলে লুটেরা সংস্কৃতির মূল উৎপাটন করতে হবে। রাজনীতি যদি দোষারোপের মধ্যেই নাক-মুখ ঢুকিয়ে বসে থাকে, তাহলে কোনো দিনও রাজনৈতিক পরিবেশ গণতান্ত্রিক ও উন্নত হবে না। রাজনীতিকদের মনে করতে হবে, দেশের জনগণের কথা , তাদের প্রতি দেয়া সাংবিধানিক ওয়াদা ও অঙ্গীকারের কথা। ন্যায় ও আইনের শাসনের কথাও মনে রাখতে পারলে সন্ত্রাসীরা চক্রান্ত করতে সাহসী হবে না। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিষয়টি নিপাত যাবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

রাজনীতিকদের মনে করতে হবে, দেশের জনগণের কথা , তাদের প্রতি দেয়া সাংবিধানিক ওয়াদা ও অঙ্গীকারের কথা। ন্যায় ও আইনের শাসনের কথাও মনে রাখতে পারলে সন্ত্রাসীরা চক্রান্ত করতে সাহসী হবে না। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিষয়টি নিপাত যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।