আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের দায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১২:২২ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২১

সারাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির যখন রমরমা অবস্থা, তখন কোন্দল-কাঁটায় বিদ্ধ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কান পাতলে শোনা যায় এলাকায় এলাকায় বিবাদ। দল টানা ১২ বছর ধরে ক্ষমতায়, কিন্তু আওয়ামী লীগের যেকোন স্তরের নেতা কর্মীর সাথে কথা বললে দেখা যায় তারাই সবচেয়ে অসুখী। একের বিরুদ্ধে অন্যের অভিযোগ করছেন। এমপি’র সাথে মেয়রের দ্বন্দ্ব, মেয়রের সাথে চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্ব, দলের বিভিন্ন শাখা কমিটির সভাপতির সাথে সাধারণ সম্পাদকের বিরোধ, মনোনয়ন ও পদ বাণিজ্য ছাড়া রাজনৈতিক কোন আলাপই যেন নেই শাসক দলের ভেতর।

চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৮৯৭ জন প্রাথী রয়েছেন যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী। এদের বলা হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’। এতে তৃণমূলে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, ৮৯টি ইউপিতে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে আওয়ামী লীগ। প্রথম ধাপের ৮টি ও দ্বিতীয় ধাপের ৮১ ইউপিতে নৌকার কোনো প্রার্থী দেয়নি দলটি।

দলে কোন্দল সৃষ্টি করে বিপক্ষের ঐক্যে ফাটল ধরানো পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল। এখন বিরোধী পক্ষ নেই। নিজেরাই নিজেদের সাথে মারামারি, খুনাখুনি করছে আওয়ামী লীগ। গত এক সপ্তাহে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আর আহত হয়েছেন অসংখ্য। এমন সব খবর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরদের কতটা বিব্রত করে সেটা আমরা জানিনা। খোদ দলের সাধারণ সম্পাদকের সংসদীয় আসনে তার ছোট ভাইয়ের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সহিংসত বিরোধ দেখছি আমরা। দেখেছি রাজধানীতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথে সদ্য প্রাক্তন মেয়র সাঈদ খোকনের কথার লড়াই। তবে স্থানীয় পর্যায়ে অবস্থা একদম বেগতিক।

দল বলছে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আগের ঘটনাগুলোয় কোথাও কোন কঠোর ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। যারা বিদ্রোহী তারা কেন বিদ্রোহী হলেন তাদের কথা একটা সুস্থ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে শোনা হয়েছে কিনা সে সবও আমরা জানিনা। তবে কথা বললে বুঝতে পারি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীতা বাছাই ঠিকমতো হচ্ছেনা অনেক জায়গাতেই। না হয় কি করে স্বাধীনতা বিরোধি দল বা পরিবার থেকে, সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দেওয়া ব্যক্তিরাও মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন। বেশি লেখালেখি হলে দু’একটি বাতিল হচ্ছে। কিন্তু প্রার্থিতা বাছাইয়ের ত্রুটি সারছে না।

টানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এবং বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ায় প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাবি-স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং এবং কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজনপ্রীতি ও মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নানা কারণে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। এ কারণে নিজেদের ‘অধিক জনপ্রিয়’ দাবি করে মাঠ ছাড়ছেন না তারা। গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে আাওয়ামী লীগের কেন্দ্রে। এসব অভিযোগে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন।

নানা কৌশলে ‘বিতর্কিতরা’ দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন অনেক বঞ্চিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। কারণগুলো স্পষ্ট – দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সবার মধ্যে ক্ষমতা চর্চার প্রতিযোগিতা চলছে, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজন পোষণ ও অর্থ লেনদেন হচ্ছে, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিংও চলছে। এসবই আমাদের বলে দেয়, দলে কোন চেইন অব কমান্ড নেই।

আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল নিতান্তই চেনা ঘটনা। দলের অন্দরেই তা নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগও উঠতে দেখা গেছে। নির্বাচন এলে এই কোন্দলের সহিংস রূপটা দেখা যায় আরও বেশি করে। যারা কোন্দল সৃষ্টি করেন, যারা কেন্দ্রে বসে অযাচিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেন, মনোনয়ন ও পদ বানিজ্য করেন তাদের ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্ব তেমন কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন তেমন নজির নেই। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন তাদের ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৬ সালে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তাদের বহিষ্কারের ধারা অন্তর্ভুক্ত করে। তারপরেও, বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করতে পারছে না আওয়ামী লীগ।

অনেকেই আছেন, নির্বাচনে দলের বিক্ষুব্ধদের মদত দিয়ে অন্তর্ঘাত করছেন অনেকেই। তারাই থাকছেন বহাল তবিয়তে। বিরোধী দল বিহীন একতরফা নির্বাচন যেহেতু হয় তাই এই বিবাদ, অন্তর্ঘাত, হিংসার ফলাফল বুঝতে পারছে না শাসক দল। আর সেজন্যই এবারের পূজার মত বহু ঘটনায় আমরা দেখছি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকাতে পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভরতা ছাড়া কোন শক্তিই দেখাতে পারছে না আওয়ামী লীগ।

শুধুই সাফল্য নয়, পরাজয়ের দায় স্বীকার করাটাও রাজনীতিকদের শিখতে হবে। এবার দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা, নোয়াখালী, রংপুরের পীরগঞ্জ বা চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে যা ঘটেছে, কিংবা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে জঙ্গি তৎপরতা হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগকে কেন খুঁজে পাওয়া গেল না সেটার উত্তর খুঁজতে হবে। আওয়ামী লীগ বড় দল, কিন্তু বড় ঘটনায় তাকে পাওয়া যায় না। পুলিশি পাহারায় সাজানো গোছানো মিছিলে গলাবাজি করা ছাড়া নেতাদের দেখা যায় না। এই অবস্থার বড় কারণ রাজনৈতিক চর্চার চেয়ে ক্ষমতার চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া।

সাফল্যের দাবিদার হওয়ার জন্য রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সাফল্যের জনক বহু। কিন্তু পরাজয়ের পর কেউই তার দায়িত্ব নিতে চান না। পরাজয় তাই আক্ষরিক অর্থেই এতিম। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শাসক দলের পরাজয়। যেসব এলাকায় হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছে সেসব এলাকার স্থানীয় নেতৃত্বকে এই দায়িত্ব নিতে হবে কিংবা কেন্দ্র থেকে নেওয়াতে হবে। অন্যথায় দলের প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা যাবে না। প্রত্যেককেই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অভ্যাসটা ছাড়তে হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

আওয়ামী লীগ বড় দল, কিন্তু বড় ঘটনায় তাকে পাওয়া যায় না। পুলিশি পাহারায় সাজানো গোছানো মিছিলে গলাবাজি করা ছাড়া নেতাদের দেখা যায় না। এই অবস্থার বড় কারণ রাজনৈতিক চর্চার চেয়ে ক্ষমতার চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।