আফগানদের জীবন-মৃত্যুর লড়াই কবে থামবে?
ইয়াহিয়া নয়ন
খরা, সংঘাত এবং অর্থনৈতিক দৈন্য’র মিলিত প্রভাব ব্যাপকভাবে আফগান জনগণের জীবিকা ও খাদ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। আফগানিস্তানে প্রতি তিনজনে একজন মানুষ খাদ্যাভাবে ভুগছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। ফলে সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। সেইসাথে দেশটিতে কয়েক লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তালেবান ক্ষমতায় আশার পর যা বেড়েছে বহুগুণ।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ১৪ লাখ মানুষই খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। অপুষ্টিতে ভুগছে ২০ লাখেরও বেশি শিশু। দেশটিতে বর্তমান আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশিতে, যার প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে ডব্লিউএফপি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আরও বলছে, এ বছরের শেষে সেখান থেকে আরও অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন।
ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে খাদ্য সহায়তা দেয়া শুরু করবে সংস্থাটি। তবে এ কাজে কোন অতিরিক্ত সহায়তা পাচ্ছে না তারা। করোনাভাইরাস মহামারির আগে আফগানিস্তানের প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করত। এখন ধারণা করা হচ্ছে, শীঘ্রই এ হার গিয়ে দাঁড়াবে ৭২ শতাংশে। অতীতের সেই নিষ্ঠুর তালেবান শাসন আবার ফিরবে না তো? কুড়ি বছর পর কট্টর ইসলামি দল তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় এমন আরো নানা শঙ্কা নিয়েই দেশ ছাড়তে মরিয়া দেশটির হাজার নাগরিক।
বিবিসির একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশত্যাগ করা আফগান নাগরিকদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত পারাপারের সবগুলো পয়েন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। তারা জানিয়েছে, তারা চায় না আফগান নাগরিকরা দেশ ছেড়ে যাক। বিভিন্ন সূত্রের খবর বলছে, ব্যবসায়ী এবং যাদের বিদেশ যাওয়ার গ্রহণযোগ্য ছাড়পত্র রয়েছে তারাই কেবল সীমান্ত পেরোতে পারছেন।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) একজন মুখপাত্র বলেন, ‘আফগানদের বড় একটা অংশই স্বাভাবিক উপায়ে দেশ ছাড়তে পারছে না। এখনও যারা বিপদে আছে তাদের বের হবার কোনো পথ নেই।’ বলা হচ্ছে, তালেবান কাবুল দখলের পর কয়েক হাজার নাগরিক পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে। এছাড়া দেড় হাজার আফগান উজবেকিস্তানে প্রবেশের পর সীমান্তের কাছে তাঁবুতে বাস করছেন। তালেবানের দখলের পর ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ বিমানে করে পালিয়েছে। তবে এর মধ্যে কতজন আফগান নাগরিক তা স্পষ্ট নয়।
দেশের ভেতরেই আনুমানিক ৩৫ লাখ আফগান বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পাশাপাশি আফগান সীমান্তে গত বছর ২২ লাখ শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয়ের সন্ধান করেছে। এ বছর প্রায় সারাদেশেই তীব্র খরা আর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। গত জুনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে রয়েছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।
গত বছর সবচেয়ে বেশি আফগান শরণার্থী দেখেছে প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং ইরান। ২০২০ সালে প্রায় ১৫ লাখ আফগান পাকিস্তানে আর ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ ইরানে আশ্রয় নিয়েছে । এছাড়া জার্মানি এক লাখ ৮০ হাজার এবং তুরস্ক এক লাখ ৩০ হাজার মানুষকে আফগানকে আশ্রয় দিয়েছে। অন্য দেশে আশ্রয় চেয়েও পায়নি এমন এক লাখ ২৫ হাজার আফগান আশ্রয় পেয়েছে তুরস্কে, জার্মানিতে ৩৩ হাজার এবং গ্রিসে ২০ হাজার। বেশ কিছু দেশ আফগানিস্তানের নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয় দিলেও অনেক দেশই তা দেয়নি ।
আফগানিস্তান অর্থনৈতিক পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা দেশটিকে নতুন রাজনৈতিক সংকটে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সুইডেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী পার ওলসন ফ্রিদ। দুবাইয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সুইডেনের মন্ত্রী বলেন, ‘দেশটি পতনের মুখে বলে আমার উদ্বেগ হচ্ছে। আমরা যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে এর পতন হচ্ছে।’ ফ্রিদ সতর্ক করে বলেন, অর্থনৈতিক পতন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিকাশের পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
গত আগস্ট মাসে পশ্চিমা-সমর্থিত সরকারের পতন এবং তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তান সংকটে পড়ে গেছে। দেশটির সাহায্যনির্ভর অর্থনীতিতে কয়েক শ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশ হিসেবে সুইডেন আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা জোরদার করেছে। তবে দেশটিতে উন্নয়নগত সহযোগিতা এখনো বন্ধ রেখেছে দেশটি। এর আগে রেডক্রসের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তালেবানের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।
আফগানরা অনাহারের ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশটির শিশুরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আসন্ন শীতে আফগানিস্তানে অনাহারে থাকা শিশুসহ কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে জরুরি অর্থসহায়তা প্রয়োজন।
আফগানিস্তান আগে থেকেই আর্থিক সহায়তানির্ভর দেশ ছিল। গত আগস্টে পশ্চিমা-সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করে তালেবান ক্ষমতা দখল করলে পশ্চিমা সহায়তা সংস্থাগুলো বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রকল্প আটকে দেয়। দেশটিতে দেখা দেওয়া খাদ্য সংকটের এটি বড় একটি কারণ। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের জের ধরে আফগানিস্তানের কৃষিপ্রধান অনেক এলাকায় খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর ফলে দেশটিতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাবারের তীব্র সংকট। আফগানিস্তানের খাদ্য সংকট এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে ১ কোটি ১৪ লাখ ডলারের তহবিল প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।
আসন্ন শীতে আফগানিস্তানে চরম অনাহারে থাকা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রতি মাসে ২২ কোটি ডলারের বেশি অর্থের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে ডব্লিউএফপি। তালেবানের পুনরুত্থানের পর দাতারা অর্থ ছাড় না করায় সংস্থাটিকে আফগানদের খাদ্যসহায়তার প্রকল্পগুলো চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক প্রকল্প সীমিত করা হয়েছে ।
বিশ্বনেতারা তালেবানের আমলে আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। আসন্ন মানবিক সংকট তাদের অগ্রাধিকারে নেই। এমন চলতে থাকলে সিরিয়ানদের মতো আফগানরাও দলে দলে উদ্বাস্তু হবে। আর উদ্বাস্তু হওয়া আফগানদের স্রোত পশ্চিমের দেশগুলোর দিকে বইতে শুরু করবে। পশ্চিমারা এই চাপ এড়াতে পারবে না।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর প্রতি তিনজন আফগানের দুজন ‘চতুর্থ পর্যায়ের’ জরুরি খাদ্য সংকটের মুখে রয়েছে। সংস্থাটির নীতিমালা অনুযায়ী, চতুর্থ পর্যায়ের এই সংকটের মানে হলো দুর্ভিক্ষের এক ধাপ নিচে থাকা। এক দশকের মধ্যে এবার সবচেয়ে ভয়াবহ শীত পড়তে পারে আফগানিস্তানে, এমনটাই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে আসন্ন শীতে দেশটিতে বিদ্যমান খাদ্যসংকট আরও প্রকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক, ডেভিড বিসলেই দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবচাইতে খারাপ না হলেও, আফগানিস্তান এখন বিশ্বে ঘোরতর মানবিক সংকটে আবর্তিত হওয়া দেশগুলির মধ্যে অন্যতম এবং সেখানে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি বলতে গেলে একেবারেই ধ্বংসপ্রাপ্ত’। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সেখানে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা না বাড়াই এবং অর্থনীতিকে যদি পুনরুজ্জীবিত না করা যায়, তবে এই শীতের মৌসুমে লক্ষ লক্ষ জনগণ অভিবাসন বা ক্ষুধা একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হবেন’। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এএফপিকে জানান, আফগানিস্তানে চলমান সংকটের মাত্রা এরই মধ্যে ইয়েমেন বা সিরিয়ার চেয়ে বেশি।
তালেবান এখন পর্যন্ত কোনো দেশের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। গোষ্ঠীটির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও বলবত রয়েছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) সম্প্রতি আফগানিস্তানজুড়ে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়ে তালেবানকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে। কারণ সরকার গঠনের সময় তারা দেশে স্থিতিশীলতার অঙ্গীকার করেছিল। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফগানিস্তানের খরা পরিস্থিতি ঘন ও তীব্র হচ্ছে। আফগানিস্তানের মানবিক সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা দেশের মানুষকে চলমান পরিস্থিতি থেকে বের করার চেষ্টা করছি। বৈশ্বিক মানবিক সহায়তাও আমরা পেতে শুরু করেছি। মুজাহিদ অঙ্গীকার করে বলেন, ‘জনগণকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, কাপড়সহ অন্যান্য সহায়তা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সব উদ্বেগ দূর করা হবে।’ কিন্তু আফগান নাগরিকরা কবে সেই সুখের দিন দেখতে পাবেন তা নিয়ে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস