মন পকেটের কী হবে

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ২৪ অক্টোবর ২০২১

বছর খানেক আগে দেশের একটি বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ থেকে মালামাল চুরি ঠেকানোর অভিনব চিন্তা করা হয়েছিল। ব্যাগ-লাগেজ কেটে পকেটে করে চুরি ঠেকানোর জন্য লোডারদের পকেটবিহীন পোশাক পরে কাজ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল । বিষয়টি কারো কারো কাছে হাস্যকর মনে হলেও আমাদের সমাজের বর্তমান বাস্তবতায় বেশ কিছু গুরুত্ব বহন করে।

সাধারণত জামা-প্যান্টের প্রয়োজনীয় পকেট না থাকা বাহ্যিকভাবে বড় অসৌন্দর্য্যের ব্যাপার। পকেটের মানিব্যাগে টাকা-পয়সা, চশমা, পকেট ডায়েরি, জরুরি দু’একটা ওষুধ, মোবাইল ফোন এমনকি প্রিয়জনের তথ্য ও ছবিও কেউ কেউ সব সময় বহন করে থাকেন। এগুলোতে জীবাণু থাকতে পারে জন্যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে সাধারণত খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও ওষুধ তৈরির কারখানায় কাজ করতে ঢোকার সময় কর্মীদের এসব নিজস্ব জিনিসপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় লকারে রেখে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ কেটে পকেটে করে চুরি ঠেকানোর জন্য লোডারদের পকেটবিহীন পোশাক প্রদান আমাদেরকে চুরি নামক অপরাধের উপস্থিতির জানান দেয়। তার অর্থ সেখানকার বড় কর্তারা সাধু এবং নিন্মশ্রেণির কর্মচারীরা সবাই চোর-এই অর্থ বুঝায়। সাথে সাথে বাংলাদেশী সমাজের এক চরম ও হীন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মত নিরাপদ ও স্পর্শকাতর জাগায় বিদেশী নাগরিকদের কাছে চুরির মত এক কুৎসিত পেশা অনুশীলনের সংবাদ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে। এটা আমাদের বিমানবন্দরকে একটি নিরাপত্তাহীন স্থান ও জাতি হিসেবে বহির্বিশ্বের কছে এক ঘৃণিত ও হেয় মানুষের ইঙ্গিত দেয়। সেখানে চোর আছে বলে আমরা বিদেশীদের কছে যেন নিজেদের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করছি।

অবশ্য সংবাদ মাধ্যমে আমাদের দেশের সরকারি অফিসের অনেক পিওনেরও ঢাকা শহরে দশতলা অবৈধ ফ্লাট বাড়ি আছে বলে জানা গেছে ও বড় কর্তাদের অনেকের দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, বাগান বাড়ি কেনার কথাও শোনা গেছে। তাহলে ছোট-বড় সব ধরনের চোরদের উপস্থিতি সেখানে রয়েছে। তাই চোরের অপবাদ শুধু নিন্ম শ্রেণির চাকুরেদের না দিয়ে বড় বড় কর্তাদেরও পকেটবিহিন পোশাক পরিধান করে অফিসে আসা উচিত। তবে কথা হচ্ছে পকেটবিহিন পোশাক কি চুরি ঠেকাতে পারে? তাই যদি হয় তাহলে সিঁদেল চোরেরা উলঙ্গ হয়ে গৃহস্থের ঘরে চুরি করতে ঢোকে কেন?

পরিধানের কাপড় তাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে। শুনেছি আগেকার দিনে অন্ধকারে ন্যাংটো চোরকে গৃহস্থ বা কোন সদস্য জেগে গিয়ে দেখতে পেলে চোর দাঁত খিচিয়ি মামদো ভূতের মত গোঁ গোঁ করে ভয় দেখায়। এত হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠা যে কেউ ভূত মনে করে ভয় পায় ও মূর্চ্ছা যায়। আর ঐ সুযোগে নেংটো চোর ব্যাটা ভোঁ দৌড় দিয়ে দ্রুত পালিয়ে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিমানবন্দরের আধুনিক ফ্লাড লাইটে তো ঐ সুযোগ নেই। তাই পকেট সম্বল।

কথা হলো বড়রা বড় জিনিস ও ছোটরা ছোটখাটো জিনিস চুরি করে থাকে। তবে যে কোন জায়গাতেই সবাই চোর নন। অনেক সময় চুরি করে দু’একজন। আর চুরির অপবাদ নিতে হয় সবাইকে। বিদেশী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সতর্কতা চোখে পড়ার মতো। আমাদেরও তাই। কিন্তু তার পরেও প্রায়শই সোনা ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করার কথা শোনা যায়। সোনা ও মাদকদ্রব্য পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় আমাদের দেশের বিমানবন্দর। তার কারণ এখানে দুর্নীতিবাজ লোকেরা দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে সহজে ছোট-বড় কোন না কোন কর্মীর মনের মধ্যে প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। চুক্তি ছাড়া এধরনের একসেস্ পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রী দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে পেট, মলদ্বারে, শরীরের চামড়ার নিচে সেলাই করে, বিমানের সিটের নিচে, টয়লেটে, লাগেজে সোনা, মাদক, ডলার, মুদ্রা ইত্যাদি আনা-নেয়া করা হয়ে থাকে। যারা সারা বছর এগুলোকে ব্যবসা-পেশা হিসেবে মেনে নিয়ে তৎপরতা চালায়। এজন্য লবিং-গ্রুপিং করে। ঘুষ দিয়ে চুক্তি-বাজি করে। লোডারদের কি শুধু পকেট আছে-এদের কি পকেট নেই? এরা ছাড়াও কর্মরত অন্য সবারই পকেট আছে।

বিদেশী এয়ারপোর্টে ব্যাগেজ হারিয়ে গেলে সাতদিন পর অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন আমাদের দেশে লাগেজ হারালেও পাওয়া যায়। তবে কাটা-ছেড়া, সেখান থেকে দামী জিনিসগুলো উধাও হয়ে যায়।

এছাড়া কেউ যদি মালামাল হারানোর অভিযোগ করেন তাহলে তার হয়রানীর সীমা থাকে না। মনে হয়- অভিযোগ করাটাই যেন বড় অপরাধ। বিমান বন্দরে কর্মরতগণ সবাই মোটামুটি সচ্ছল পরিবার থেকে চাকুরি করতে আসার সুযোগ পান। তাই সবকর্মীরা অভাব বা দারিদ্র্যের কারণে লাগেজ কেট মালামাল চুরি করেন এই ধারণা ভ্রান্ত। এটা আসলে মনের অভাব বা মনের রোগ। সেখানে সুপারভাইজার আছেন। যাদের অবহেলা অনেক। জবাবদিহিতা খুব কম। এদের অবহেলা ও ফাঁকিবাজি থেকে যাত্রী হয়রানি বেড়ে যায়।

মালামাল আনা নেয়ার সময় বিমানের পেটের তলা থেকে লাগেজ বেল্ট পর্যন্ত সিসি ক্যামেরা দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। নিন্মশ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়ানোর কথা থাকলেও তা বাড়ানো হয়নি। বেতন কম, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বেশি ও সংসারের চাহিদা বেশি থাকায় অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব ঘৃণ্য কাজ করেন। অনেকে আবার দ্রুত বড়লোক হবার আশায় অথবা গাড়ি-বাড়ি কেনার লোভে স্বর্ণ, মাদক প্রভৃতি চোরাচালানীদের সাথে যোগসাজশ করে ওদেরকে সহযোগিতা করে অবৈধ মালামাল পার করে দিতে তৎপর থাকেন। ক’দিন আগে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে সন্দেহবশত চ্যালেঞ্জ করা হলে তিনি কয়েকশত স্বর্ণের বিস্কুট নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় দেশের আরেকটি বড় বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এদের অনেকের অনেক জমানো সম্পদ থাকলেও নিয়মিত চুরি করে আরো বেশি অবৈধ কামাই করতে সদা তৎপর থাকেন। কারণ এদের মনটা কলুষিত ঘুষের নেশায়। এদের ঘন ঘন মোটিভেশনাল সেমিনার ও ট্রেনিং হবার কথা থাকরেও তা নিয়মিত হয় না। নৈতিকতা উজ্জীবনমূলক ওয়ার্কশপের মাধ্যমে লোভ সম্বরণ করা ও দুর্নীতি পরিহার করে যাত্রীসেবা বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হবার মত কর্মসূচি আরো বেশি বেশি গ্রহণ করা উচিত।

বিমানবন্দরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরকে সবচে বেশি কাজ করতে হয়। ব্যাগেজ লোডারদেরকে দ্রুততার সাথে শ্রমঘন কাজটি সম্পন্ন করতে তৎপর থাকতে হয়। এদের জন্য সাথে মোবাইল ফোন সেট রাখা জরুরি। পকেট না থাকলে সেটা তারা কোথায় রাখবে? আসলে পকেটবিহীন পোশাক চৌর্যবৃত্তি নির্মূলে কোন সমাধান নয়- সমাধান হলো সবার নৈতিকতার জাগরণ ও সব কাজে তার প্রতিফলন ঘটানো। বিমানবন্দর কর্মীদের সবার মনের মধ্যে নৈতিকতা নামক একটি গুপ্ত মন পকেট রয়েছে। সেই গুপ্ত মন পকেটে যদি নাপাকিসহ ময়লা আবর্জনা ঢুকাতে দ্বিধা ও ঘৃণাবোধ না থাকে তাহলে শুধু তারই পক্ষে পকেটবিহীন পোশাক প্রযোজ্য হবে। অন্যথায় ব্যাগেজ কেটে মালামাল চুরি নিয়ন্ত্রণে কারো পোশাকে পকেট থাকা-না থাকা কোন যৌক্তিক ও টেকসই সমাধান নয়।

আরেকটি হলো দালাল ঠেকানো। গোটা দেশের সকল অফিস-আদালত ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো দালালদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অবৈধ দালালদের জন্যে অর্থব্যয় ছাড়া যে কোন সেবা পাওয়া জটিল হয়ে পড়েছে। বিমানবন্দরে একটি ট্রলি পেতে দালালরা ঘুষ চেয়ে বসে। বিশেষ করে নতুন কোন নিরীহ যাত্রী দেখলে তো কথাই নেই। একটি কুচক্রী মহল এসব দালালকে মাদক পাচারে ব্যবহার করে। চুরি করা মালামাল এদেরকে দিয়ে দ্রুত বিমানবন্দরের বাইরে সরিয়ে ফেলা হয়। এরা অযথা বিমানবন্দরের বাইরে দাড়িয়ে ভিড় করে ও রাস্তায় যাত্রীদের মালামাল ছিনতাই করার জন্য মোবাইল ফোনে নিরীহ ও একা যাত্রী বা দর্শনার্থীদের তথ্য রাস্তায় অপেক্ষমান হাইজ্যাকারদেরকে জানিয়ে দেয়। তাই এই দালালদের ভূমিকা বড় ভয়ংকর। শুধু বিমানবন্দর নয়- দেশের সকল অফিস প্রেমিস বা প্রাঙ্গন থেকে দালাল ও তাদের দোসরদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]

এইচআর/এমএস

গোটা দেশের সকল অফিস-আদালত ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো দালালদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অবৈধ দালালদের জন্যে অর্থব্যয় ছাড়া যে কোন সেবা পাওয়া জটিল হয়ে পড়েছে। বিমানবন্দরে একটি ট্রলি পেতে দালালরা ঘুষ চেয়ে বসে। বিশেষ করে নতুন কোন নিরীহ যাত্রী দেখলে তো কথাই নেই। একটি কুচক্রী মহল এসব দালালকে মাদক পাচারে ব্যবহার করে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।