বাংলাদেশ আর সম্প্রীতির দেশ হবে না?
আশঙ্কাটা আগে থেকেই করা হচ্ছিল যে এবার দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। যারা দেশের রাজনীতির স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় থাকুক তা চায় না, যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায় তারা কিছু একটি অঘটন ঘটিয়ে পরিস্থিতি তাতিয়ে তুলতে চায় বলে কারো কারো মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। কেউ কিছু করতে চাইলেও পারবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সতর্ক আছে।
সতর্ক থাকা সত্ত্বেও পূজা উদযাপনে শুধু বিঘ্নই ঘটেনি, পূজার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-আক্রমণ অব্যাহত আছে। এর শেষ কোথায় তা বলা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা দেওয়ার পরও একের পর এক অঘটন ঘটতে থাকা ভালো লক্ষণ নয়। কুমিল্লার একটি অস্থায়ী দুর্গামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে ভাঙচুর- হামলা শুরু হলেও পরে তা হিন্দু পল্লিতে আগুন দেওয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে। আহত-নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম শঙ্কা বিরাজ করছে। তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা আর রাষ্ট্র দিতে পারবে কিনা বা দিতে চায় কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসছে। বাংলাদেশকে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয়, সেটাও কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। আশাবাদী বলে পরিচিত মানুষের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে হতাশা। এই সব ঘটনায় নতুন করে হিন্দুদের দেশত্যাগ করার প্রবণতা বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা আর বাংলাদেশে ফিরে আসবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি স্লোগানসম্বলিত পোস্টার জনপ্রিয় হয়েছিল ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান-আমরা সবাই বাঙালি'। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিল চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন।
ধর্মনিরপেক্ষতার কথা মুখে বলা হলেও সেটা বাস্তবে আর সেভাবে অনুসরণ করা হয় না। এমনকি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসারী বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ এখন মুখে ধর্মনিরপক্ষতার কথা বললেও অনুসরণ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার নীতি। প্রতি থানায় মডেল মসজিদ নির্মাণের ঘটনা প্রমাণ করে না যে সরকার বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখায় না। আমাদের দেশে মসজিদের সংখ্যা কম বলে নামাজ পড়তে সমস্যা হচ্ছে, এমন দাবি কি কেউ তুলেছিল? জোড়াতালি দিয়ে শেষ রক্ষা হয় না, হচ্ছেও না। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেও সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। কোথাও কিছু ঘটলে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও একের পর এক ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিন্দুদের গলাবুক জ্বলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত দশ বছরে হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর গুজব ছড়িয়ে যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও পেছনের ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না– বলে হুংকার দেওয়া হলেও বাস্তবে সবাই ছাড় পেয়ে যায়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার উদ্যেগ নিলে নিরাময়ের যে সম্ভবনা থাকে, জটিল হয়ে পড়লে শল্য চিকিৎসাতেও ফল পাওয়া যায় না। যদি প্রথম ঘটনার পর অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে হয়তো এভাবে বার বার একই রকম চিত্রনাট্য রচনা করে মঞ্চ মাতানো সম্ভব হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-নেতারা কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই বক্তৃতায় বলছেন, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে কি?
বলা হচ্ছে, এসবের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে, ঘটনাগুলো পরিকল্পিত এবং এর পেছনে রাজনীতি আছে। এসব কথা সত্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন আসে, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে, অপরাজনীতির শিকড় উপড়ে ফেলতে সরকার এবং সরকারি দল কি করছে? বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের হাত পরিষ্কার করার সহজ পথ থেকে বেরিয়ে না এলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
সরকারকে প্রশাসনের দুর্বলতা এবং সরকারি দলের আদর্শিক বিচ্যুতির কথা স্বীকার করতে হবে। নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে নৌকা প্রতীক দেবেন, বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা সুবিধাবাদী হাইব্রিডরা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবে আর কিছু হলেই বিএনপি-জামায়াতের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলবেন, সেটা কি মানুষকে খুব উৎসাহিত করতে পারছে?
যেসব জায়গায় গুজব ছড়িয়ে, মাইকিং করে লোক জড়ো করে মন্দির বা হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করছে সেসব জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ অন্য লীগারা কি ঘুমিয়ে ছিলেন? অপশক্তি প্রতিরোধে মানুষকে সংগঠিত করার রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করা হয় না কেন? সরকারি প্রশাসনের সতর্কতাই বা কোথায়? এত এত গোয়েন্দা সংস্থা তারাই বা আগে থেকে কোনো তথ্য জোগাড় করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারে না কেন? আইসিটি আইন কারো জন্য দ্রুত কার্যকর হয়, কারো বেলায় উদরতা কেন?
ফেসবুকে যারা উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, ওয়াজের নামে কয়েকজন হুজুর যেভাবে অন্য ধর্মের প্রতি দিনের পর দিন বিষোদ্গার করে চলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? আইন প্রয়োগের বৈষম্য আসলে আইন না মানার পথ তৈরি করে। সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুতের সব ধরনের সুযোগ অবারিত করে তারপর বলবেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, তারচেয়ে বড় রসিকতা আর কি হতে পারে?
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শেষ করতে চাই একজন প্রবাসী সাংবাদিকের একটি ফেসবুক পোস্ট উদ্ধৃত করে। শওগাত আলী সাগর লিখেছেন : ‘বাংলাদেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মন এবং মনন সাম্প্রদায়িক। উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা আছে – এটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই এর প্রতিকার খুঁজতে হবে। সমস্যাকে অস্বীকার করলে, মেহনীয় সব শব্দাবলীতে আড়াল করে রাখলে সংকট বাড়বেই কেবল। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ – এই আপ্তবাক্যে ফাটল ধরেছে অনেক আগেই। সেই ফাটল দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকছেই কেবল -এ সত্য অস্বীকার করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সমস্যাকে স্বীকার করুন। তারপর সমাধানের উদ্যোগ নিন'।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম