নাচতে না জানলে
প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরলে সাংবাদিক ও সম্পাদকদের মুখোমুখি হন, নানা প্রশ্নের জবাব দেন। এবারও জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশন থেকে ফিরলে এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেন গবেষণা কেন কম হচ্ছে তা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন বিষয়টি দুঃখজনক।
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে পরিমাণ গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হচ্ছে, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। পাবিলক তথা সরকারি বা বেসরকারি- দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান এবং পরীক্ষা নিয়ে গ্র্যাজুয়েট সৃষ্টির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত এক তথ্য অনুসারে, দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাবলিক (সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে কোনো গবেষণা কার্যক্রম হয়নি।
একটা সময় বলা হতো, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো শিক্ষক হতে হলে ভালো ‘পি’ থাকতে হয়। এই ‘পি’ হলো পাবলিকেশন। গবেষণা থাকতে হবে, ভালো ভালো জার্নালে গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশিত হতে হবে। এখন আর সেদিন নেই, তবে ‘পি’ ঠিকই আছে। এই ‘পি’ হলো পলিটিক্স। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলবাজ রাজনীতিতে কে কতটা পারদর্শী তার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় একজন শিক্ষক প্রমোশন কীভাবে, কীভাবে বিভিন্ন পদ-পদবি অর্জন করবেন। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের নামে চলে ভোটার নিয়োগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা এরকম এক ‘পি’ তথা পারসেপশন।
নিছক জ্ঞানস্পৃহা নয়, নতুন জ্ঞান, নতুন উদ্ভাবন, নতুন দিকে চিন্তার প্রসারই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের প্রধান পরিমাপক। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনের কৌশল হতে উন্নয়নের নীতি, যে কোনো ক্ষেত্রেই গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের প্রয়োগ হতেই অগ্রগতি সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় সেই জ্ঞানচর্চার আঁতুড়ঘর। সেটা যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না পাওয়া যায় তাহলে জাতির অগ্রগতি আশা করা বৃথা। বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি দানের লাইসেন্সপ্রাপ্ত কারখানায় পরিণত হয়ে যদি গবেষণা একটি ‘ঐচ্ছিক বিষয়’-এ পরিণত হয় তাহলে আমাদের সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
তৃতীয় বিশ্বের বহু দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য মাথাপিছু খরচ অনেক কম, এটা আমরা জানি। বলতে গেলে গবেষণায় প্রায় সব দেশের পশ্চাতে আমরা। গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ব মানচিত্রে এ দশায় যে দেশেরই ক্ষতি, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সেদিন তার সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করেছেন।
শিক্ষকরা বলেন বাজেট নেই। এটা অনেকটা সেই প্রবাদের মতো কথা– নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গবেষণার জন্য আমাদের ফান্ড আছে, বিশেষ ফান্ড আছে। তবু কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য অনীহা, আমি জানি না।’ এ প্রশ্ন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেরই। দেশে শিক্ষা বিষয়ে যে কোনো আলোচনায় এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রায় সময়ই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় অবস্থান করছে সে প্রশ্নও ওঠে। এতে বোঝা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মানের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। তাদের গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। বাজেট কম, কিন্তু যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও ব্যবহৃত হয় না, এমনটা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে অবহেলার ফলে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। যারা উৎকৃষ্ট গবেষক, তারা হয় বিদেশে চলে যাচ্ছেন অথবা দেশে বসেই আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত দ্বিতীয় শ্রেণির গবেষকদের নিয়ে চলছে। এতে গবেষণার মান নামছে। বহু ক্ষেত্রেই গবেষণাপত্রের নামে যা প্রকাশিত হয়, সেগুলো কতটা গবেষণা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খোদ শিক্ষকরাই একে অন্যের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করছেন। অনেকে বলেন, এদেশে আসলে গবেষণার একটা সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি। গবেষণার প্রয়োগযোগ্যতা, তার তথ্যে বা বিশ্লেষণে নতুনত্ব, এর মূল্যায়ন সেভাবে নেই।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় যে ব্যাপ্তি ঘটেছে, তার সঙ্গে মানোন্নয়নের ভারসাম্য আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য অবকাঠামোর ক্রমাগত সংস্কার তো দরকারই, সেই সাথে দরকার যোগ্য ভালো শিক্ষক। সরকারি অনুদান বাড়লে ও যথাযথ উদ্যোগ নিলে এ দিকটা সামলানো যাবে। কিন্তু মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকা পাওয়া, যারা শুধু চাকরিই করবেন না, সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী হবেন।
বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলে ইতিবাচক ফল পাওয়া পাবে, এমনটি আশা করা যায়। কিন্তু শুধু বাজেটই সবকিছু নয়। গবেষণানির্ভর করে গবেষকদের গুণমান এবং প্রতিষ্ঠানে বিদ্যাচর্চার পরিবেশের ওপর। ভালো গবেষক থাকলে এবং গবেষণার অনুকূল পরিবেশ থাকলে জ্ঞানের চর্চা হয়। পরিবেশটা যদি শুধু রাজনীতি উপযোগী হয় তাহলে গবেষণার পরিবেশ ও গবেষণায় উৎসাহ- দুটোই কমে যায়। শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান প্রধান আর তাদের নেতৃত্ব যদি দলীয় নেতৃত্বের পায়ে আপন স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে ব্যগ্র থাকেন, তবে উচ্চশিক্ষা নিচে নামতে বাধ্য।
গবেষণায় ইতিবাচক ফল পেতে হলে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত থাকা উচিত মানসম্মত গবেষণা বা প্রকাশনা। গবেষণায় মানের বিষয়টিও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। যে গবেষণা বিশ্বসমাজে স্বীকৃতি পাবে না, তেমন গবেষণাকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া ঠিক হবে না।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এএসএম