সাংবাদিক নেতারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়
গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১১ জন সাংবাদিক নেতার যাবতীয় তথ্য চেয়েছে বলে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে ওই সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব খোলার তথ্য, শুরু থেকে হালনাগাদ লেনদেনের বিবরণী, স্থিতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবকিছু ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে হবে।
যাদের ব্যাপারে তথ্য চওয়া হয়েছে বলে পত্রিকায় নাম এসেছে তারা হলেন- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, বিএনপি সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, বিএনপি সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আব্দুল মজিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোরসালীন নোমানী এবং সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান খান।
এই হিসাব চাওয়াটা নিয়ে আমার জানা মতে কারও চরম আপত্তি নেই। কিন্তু নিউজটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো কেন এবং শুধু সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাওয়া হলো কেন- এ নিয়ে যাদের নাম তালিকায় আছে তাদেরসহ অনেকের আপত্তি আছে দেখতে পাচ্ছি। তাদের কারও কারও প্রশ্ন তোলার ধরনে মনে হচ্ছে সাংবাদিক নেতারা আইনের ঊর্ধ্বে এবং কেউ দুর্নীতিবাজ নন, টাকা পাচারে জড়িত থাকতে পারেন বলে সরকারের সন্দেহ করা ঠিক নয়। তালিকায় যে ছয়টি সংগঠনের শীর্ষ নেতার নাম এসেছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির নাম বাদ পড়েছে। তাই সংগঠন করেন বলেই তাদের নাম তালিকায় এসেছে, ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয়েছে- সেটাও পূর্ণাঙ্গ সত্য বলে দাবি করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আমি একটি জেনারেল স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে। আমি বলেছিলাম, ‘ঝাড়ুদার সমিতির নেতা হতে গেলেও এখন টাকা খরচ করতে হয়, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। সুতরাং যারা নির্বাচিত হয়েছেন শুধু তাদের নয়, যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদেরও ব্যাংক হিসাব তলব করা দরকার। মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের সব স্তরের নির্বাচনেই ভোটাররা এখন সৎ ও যোগ্য পদপ্রার্থী পান না। যোগ্য লোক নির্বাচনে প্রার্থী হতেও পারেন না। ভোটাররা তাই প্রার্থীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বৃত্তকেই বেছে নেন। টাকার জোরে দুর্বৃত্তরাও বিজয়ী হয়।’
আমার স্ট্যাটাসকে সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাওয়ার ঘটনার সঙ্গে সংযোগ করে বিএনপি সমর্থক এক সিনিয়র সাংবাদিক বললেন, তোমার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত কিন্তু শুধু সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাওয়ার মধ্যে রহস্য রয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে তাদের কাছে হিসাব চাইলে কারও আপত্তি করার কথা নয়।
আরেকজন সাংবাদিক আমার উদ্দেশ্যে ফেসবুকে মন্তব্যে করেছেন, ‘যাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে তারা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন, যেদিন এ খবর প্রকাশিত হয় সেদিনই প্রথম আলো এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট করেছিল। যেখানে নেতারা বলেছেন, তারা চান ব্যাংক হিসাবের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক।’
তিনি যোগ করেন, ‘তাদের আপত্তিটা হচ্ছে তাদের এখানে ব্যক্তি হিসেবে নয় সংগঠক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, সংগঠনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যক্তির নামে হয় না। যাদের ব্যাপারে সন্দেহ হয় তাদের ব্যাপারেই হিসাব তলব করা হয়, এমন কি হলো যে ১১ জন নির্বাচিত সাংবাদিক নেতার হিসাব তলব করতে হলো? এ ঘটনায় কিছু না হলেও তারা পরিবার, স্বজন ও সমাজের কাছে সন্দেহভাজন হয়ে গেছেন। এটা তাদের জন্য পীড়াদায়ক।’
আমি বুঝি না সাংবাদিকরা যে প্রতিদিন অন্য মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলবের সংবাদ করেন তখন ওইসব লোকজনের তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে মুখ দেখানো কি কষ্টের হয় না? নাকি লজ্জা শুধু সাংবাদিকদের আছে বা সাংবাদিক নেতারা দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে? সবচেয়ে বড় কথা, তালিকাভুক্ত সাংবাদিকরা নিজেদের হিসাব নিজেরা প্রকাশ করছেন না কেন! তা করে এরপর যদি সাংবাদিকরা এমপি-মন্ত্রী-রাজনীতিক-আমলাদের হিসাব প্রকাশের জন্য চাপ দিতেন তাহলে তো সবাই তাদের প্রশংসা করতো।
সরকারের কোনো সংস্থার যদি সাংবাদিক সমাজকে হেয় করার উদ্দেশ্য থাকে সেটাও মাটি হয়ে যেত। ব্যাপারটাতে সাংবাদিক সমাজেরও মুখ উজ্জ্বল হতো। বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং কারও নামে অভিযোগ আসলেই তাকে দুর্নীতিবাজ ভাবার কোনো কারণ নেই। আইনগত প্রক্রিয়ায় সেটা ভুল প্রমাণও হতে পারে।
সাংবাদিকরা কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত এসব ঘটনা দেখে আসছেন, তাই এ ঘটনায় তাদের ওভাররিয়েক্ট করার দরকার ছিল না মনে করি আমি। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে যে কারও ব্যাংক হিসাব তলব বা সম্পদের হিসাব চাইবে- সেখানে কে সাংবাদিক আর সাংবাদিক নেতা, কে পুলিশ আর কে ব্যারিস্টার সেটা দেখার সুযোগ কম। তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করার আইনগত বিধান আছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাই বেশি প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই জরুরি এবং জবাব আইনের মাধ্যমেই দেওয়া উচিত।
সাংবাদিকরা এটা নিয়ে যে প্রতিবাদ করছেন সেটা অবশ্যই তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দুই দশক ধরে আমরা দেখে আসছি সাংবাদিকদের অভিন্ন স্বার্থে দুই আদর্শের সাংবাদিক নেতারা এক হতে পারেননি, বিশেষ করে ভাঙা ইউনিয়নকে জোড়া লাগাতে পারেননি। প্রতিদিন চাকরিচ্যুত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। চাকরিচ্যুত না করে বিনা বেতনে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাকরিচ্যুতরা পাওনা বুঝে পাচ্ছেন না। ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন নেই অনেক হাউজে, মিথ্যা সার্কুলেশন দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াচ্ছে সিংহভাগ পত্রিকা। মালিকরা অপকর্ম ঢাকার জন্য সাংবাদিকদের ব্যবহার করছেন। পেশার মান ইজ্জত আর ভূলুণ্ঠিত। এসব নিয়ে সাংবাদিক নেতারা সোচ্চার নন, ঐক্যবদ্ধ নন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতা সংগঠনের টাকা নয়-ছয় করেছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাদের আইনের মুখোমুখি করা যায়নি বরং বর্তমান কর্মকর্তাদের অভিযোগ বহিষ্কৃতরা উল্টো তাদের হুমকি দিচ্ছে, মামলা করেছে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এ নিয়ে জোরোলো ভূমিকা রাখা উচিত ছিল কারণ টাকাগুলো কারও অনুদান নয়, রিপোর্টারদের নিজস্ব টাকা। আমার নিজেরও টাকা রয়েছে সেখানে।
রাজনৈতিক দলাদলিতে বিভক্ত নেতারা এখন তাদের ব্যাংক হিসাব তদন্তের ডাক আসায় এক মঞ্চে চলে এসেছেন। আমি মনে করি নেতাদের এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিক সমাজকে একটি ভুল বার্তা দেবে।
শুধু সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের হিসাব তলব কেন করা হচ্ছে- এ প্রশ্নে বলবো নেতাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে! বরং এর মাধ্যমে সাংবাদিক নেতাদের স্বচ্ছতা, সৎ নেতৃত্ব প্রমাণের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সাধারণ সাংবাদিক থেকে তো সাংবাদিক নেতাদের স্বচ্ছতার দরকার আগে। মার্কিন মুল্লুকে সম্মতি নিয়ে বিবাহবহির্ভূত যে কাউকে বিছানায় নেওয়া যায় কিন্তু সে কাজ কোনো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করেছেন প্রমাণ মিললে নমিনেশন পাওয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট করলে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হয়। কেন? জবাব হচ্ছে মার্কিন ভোটাররা তাদের নেতার মধ্যে সততা, স্বচ্ছতা, পবিত্রতা দেখতে চায়। সাংবাদিকরাও তাদের ভোট প্রার্থীর কাছে স্বচ্ছতা, সততা আশা করা দোষের কিছু নয়।
কিন্তু আমরা কী দেখলাম! দেখলাম সাংবাদিক নেতারা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যায় রীতিমতো তাদের সংগঠনকে জড়িয়েছেন। এ নিয়ে সাংবাদিকদের ছয়টি সংগঠন বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন করার পর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা অবশ্য একটি ভালো কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা সবার কাছে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া যেভাবে সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে একইভাবে অন্যান্য পেশাজীবীদেরও ব্যাংক হিসাব তলব করতে হবে। সাংবাদিক নেতারা ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। মন্ত্রীদের তরফ থেকেও সাংবাদিক নেতাদের হয়রানি না করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
আশা করছি সততার জয় হবে। শুধু ব্যাংক হিসাবের ঘটনাই নয়, সবক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভাবতে হবে তারা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রের কারও কারও অন্যায় দেখলে মনে হয় তারা আইনের ঊর্ধ্বে, কিন্তু বাস্তবে তাদেরও আজ না হয় কাল আইনের মুখোমুখি হতেই হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/এএসএম