বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী : দুজনের ছিল নীতি ও আদর্শের মিল

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

আজ কেউ কেউ এট স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা ছিল এক কথায় অতুলনীয়। ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধজয় সম্ভব হতো কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে তেমনি এ ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর এক ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কমে আসছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া তার সামনে হয়তো বিকল্প থাকবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চিন্তা তার মাথায় আগেই এসেছিল। ষাটের দশকের প্রথম দিকেই তিনি তার ভাবনার কথা কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা আরও সংহত রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা যাবে না, তবে আলাদা হতে চাইলে যে সেটা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হবে না, এটাও তিনি জানতেন। তিনি জনগণকে একটি কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে তুলছিলেন। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করেছিলেন কি না, যোগাযোগ থাকলে সেটা কোন পর্যায়ে ছিল-এসব বিষয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ বা আলাপ-পরিচয়ের বিষয়েও কিছু জানা যায় না। তবে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে যে অসম যুদ্ধ শুরু হয় তার চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কার্যত ধাত্রীর ভূমিকা পালনে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজে আত্মগোপন করেননি। তিনি জীবনে কখনো আত্মগোপনের রাজনীতি করেননি। তাছাড়া তাঁকে না পেলে পাকিস্তানিরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে -এটাও তাঁর ভাবনায় ছিল। তিনি মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না। সাহসের সঙ্গে বিপদের মুখোমুখি হওয়াই ছিল তাঁর রাজনীতি। ২৫ মার্চের তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর তিনি বেঁচে আছেন কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল। তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিশ্বজনমত গড়তেও ইন্দিরা গান্ধী রেখেছিলেন অসাধারণ অবদান।

মুজিবনগর সরকার গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দান, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দেয়ার মতো সব বিষয়েই ইন্দিরা গান্ধী অকল্পনীয় দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের প্রথম দেখা হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পথে। ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে প্রথম গিয়েছিলেন লন্ডন। লন্ডন থেকে ৯ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিল্লি বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দিল্লির রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহরে পুষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। হাজার হাজার নারী-পুরুষ দিল্লি বিমান বন্দরে সমবেত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবকে একনজর দেখার জন্য।

বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে দিল্লিতে আয়োজিত সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘তার শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও তার আত্মাকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেনি। তার প্রেরণায় বাংলাদেশের মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। তিনি প্রেরণা দিতে এখন ভারতে আমাদের কাছে এসেছেন। এই যুদ্ধের সময় আমরা ভারতের পক্ষ থেকে তাদের জন্য তিনটি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

এক. যে শরণার্থী ভারতে আছে, তারা সময় হলে ফিরে যাবে।
দুই. আমরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করবো এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াবো।
তিন. শেখ সাহেবকে আমরা দ্রুত জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবো।
আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।’

এরপর বঙ্গবন্ধু ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ দেন। তিনি ইংরেজিতে ভাষণ শুরু করলে উপস্থিত জনতা সমস্বরে বাংলায় বলার অনুরোধ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনি স্মিত হাসি দিয়ে বলেন, দে নিড বেঙ্গলি তারপর বঙ্গবন্ধু ‘ভাই ও বোনেরা’ বলে বক্তব্য শুরু করতেই উপস্থিত জনতা উল্লাস ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দি ছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য।

আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার কাছে এবং তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি লোকের খাওয়ার বন্দোবস্ত এবং থাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন - আমি জানি ভারতবর্ষের মানুষ তারাও কষ্টে আছে, তাদেরও অভাব-অভিযোগ আছে, তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে, আমার লোকরে সাহায্য করার জন্য, চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারবো না।

আমরা আশা করি, আপনারা জানেন, বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে, আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এও আশা করি, দুনিয়ার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সাহায্য করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির মিল।’

মুজিব-ইন্দিরার এই প্রথম সাক্ষাৎ ছিল দুইজনের জন্যই গভীর আবেগের বিষয়। আর এই প্রথম সাক্ষাতের মাধ্যমেই দুই সরকার প্রধানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেরও ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। কয়েক বছরের ব্যবধানে দুই জনই নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। দেশের জন্য আত্মদানের অমর দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী। দুই জনের নীতি-আদর্শের মিল যে অটুট বন্ধন তৈরি করেছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা প্রেরণাদায়ী ও নিয়ামক ভূমিকা রেখেছিল।

আজ বঙ্গবন্ধু নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে স্বাধীন দেশে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। এর কয়েক বছর পর ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীও দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। নীতি-আদর্শের মিলের কারণেই কি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণের সুযোগ দুই দেশের দুই নেতা-নেত্রীর হলো না? ইতিহাসে এমন বিস্ময়কর মিলের উদাহরণ হয়তো খুব বেশি নেই।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/এমএস

আজ বঙ্গবন্ধু নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে স্বাধীন দেশে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। এর কয়েক বছর পর ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীও দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। নীতি-আদর্শের মিলের কারণেই কি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণের সুযোগ দুই দেশের দুই নেতা-নেত্রীর হলো না? ইতিহাসে এমন বিস্ময়কর মিলের উদাহরণ হয়তো খুব বেশি নেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।