ই-কমার্স: ‘আশা রাখি আলো পাব, ডুবে যাই অন্ধকারে’
‘আশা রাখি আলো পাব, ডুবে যাই অন্ধকারে’। বাউল শাহ আবদুল করিমের গানের কথার মতোই আমাদের ই-কমার্স গ্রাহকদের অবস্থা। বিরাট সম্ভাবনা দেখে মানুষ পণ্যের জন্য টাকা দিয়েছে, বড় বড় পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও সংযুক্ত হয়েছে, অথচ এখন দেখছে পুরোটাই ভেলকিবাজি। ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী (প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিন গ্রেফতার হওয়ার পর এখানে বিনিয়োগ করা গ্রাহকদের প্রশ্ন টাকা কি তাহলে মিলবে? নাকি খালি হাতেই বসে থাকতে হবে?
মানুষের এই যে উদ্বেগ, এই যে আকুতি তার কারণ আগের অভিজ্ঞতা। যুবক, ইউনিপে, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কত কত প্রতিশ্রুতির বন্যা এলো আর গেলো, কিন্তু গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পায়নি। অনেকেই বলছেন, ইভ্যালির গ্রাহকদের টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ওই টাকা আসলে আগেই হাওয়া হয়ে গেছে।
ই-কমার্স কোনো এমএলএম ব্যবসা নয়, কিন্তু ই-অরেঞ্জ বা ইভ্যালির পরিণতি দেখে আমরা বুঝতে পারলাম দেশে ই-কমার্সের নামে চলছিল ডিজিটাল এমএলএম ব্যবসা। আজ ইভ্যালির প্রধানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। অথচ এ ইভ্যালিরই স্পন্সরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চলেছিল এই এলিট ফোর্স। নীতিনির্ধারকদের জায়গায় যারা আছেন তারা কেউ হয়তো এদের গিমিক বুঝতে পারছিল না কিংবা বুঝতে পারার সক্ষমতা ছিল না তাদের যেমনটা ছিল না লাখ লাখ গ্রাহকের।
পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’-এই এক মন্ত্রে মানুষকে রাতারাতি মোহগ্রস্ত করে ফেললো ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার বা সাইক্লোন অফারের নামে নানা প্রলোভন মানুষকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করেছে যে, কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পার না হতেই এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে নানা অভিযোগও জমা হয়েছে, কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ধরন দেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা করা উচিত ছিল এখানে গ্রাহকদের জন্য ভয়ংকর ফাঁদ আছে বা মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ লুট করেছে যেমনটা করেছিল যুবক, ডেসটিনি বা ইউনিপে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অঘোষিত বড় টাকা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু বেশি আছে অতি সাধারণ মানুষের টাকা।
ই-কমার্স, সোজা ভাষায় যাকে বলে অনলাইনের মাধ্যমে কেনাবেচা সেটা গত এক দশকে বাংলাদেশে ডিজিটাল মিডিয়ামের মাধ্যমে ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বেকারত্ব যেখানে ভরপুর, সেখানে যুবসমাজ তো আছেই, অতি সাধারণ জনগণও ই-কমার্সকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক সাফল্য পেতে চাইছেন। এরকম স্বপ্নময় একটা শুরু যেন জীবন পাওয়ার আগেই মরে গেলো ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালিরকাণ্ডে। রাতারাতি কেন এসব প্রতিষ্ঠান সফলতা পেল? কারণ খুব সহজ - ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ই-কমার্স মাধ্যমে ক্রেতার ভাগ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার সম্ভাবনা যে প্রবল গতিতে বাড়ানো যায় সেটা প্রমাণ করেছে তারা। কিন্তু অঙ্গীকার না থাকলে যা হয়, সেটাই হয়েছে।
বাংলাদেশে যারা স্টার্টআপ বাণিজ্য করছে, তাদের বড় একটা অংশের মনোজগতে সাসটেইনেবল বা টেকসই হওয়ার প্রতিজ্ঞা নেই। এরা চায় কোন রকমে বড় কোন মার্কেটিং গিমিক করে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা হবে, তারপর সেটা কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা দেশের বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়সহ বিক্রি করা দেওয়া হবে। এমন পরিকল্পনা ইভ্যালির রাসেলেরও ছিল। এমন কাজ আরও অনেকেই করেছে এবং করার প্রক্রিয়ায় আছে। দুদক বলছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালির নেওয়া প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
করোনাকালে কিংবা তার আগে থেকে বলা হচ্ছিল সময় এখন ই-কমার্সের। কিন্তু বেশকিছু ঘটনায় মনে হলো সময় এখন ই-প্রতারণার। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে এ ব্যবসা গতি পায়। দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির থ্রিজি ও ফোরজি চালুর কারণে মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ কারণেই গতি সঞ্চার হয় ই-কমার্স খাতে।
ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার সম্ভাবনা যে প্রবল গতিতে বাড়ার কথা তাকে যেন থামিয়ে দিল ই-অরেঞ্জ বা ইভ্যালি। অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় সমস্যাই প্রতারণা। ক্রেতারা ঠকছেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করছেন না, যা দিচ্ছেন সেটাও খারাপ পণ্য। সম্প্রতি পরিচিত অনেকেই এ অভিযোগ করে বলেছেন, তারা আর কখনও অনলাইনে কেনাকাটা করবেন না। অর্ডার করেছেন, টাকা দিয়েছেন, কুরিয়ারে যা পাঠানো হয়েছে তা অন্য রঙের, মানও খুব খারাপ এবং ফোন দিয়ে জানালে কিছুদিন পর ফোন বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাওয়া যাচ্ছে না। এমনও হয়েছে এক নারী জামদানির অর্ডার করে পেয়েছেন নিম্ন মানের তাঁতের শাড়ি। কেনাকাটা করতে গিয়ে ছোট ছোট প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ নিয়মিত। কিন্তু টাকার অংক ছোট হওয়ার কারণে মানুষ এ নিয়ে তেমন একটা অভিযোগ করে না।
কিন্তু ই-অরেঞ্জ বা ইভ্যালিতে বিনিয়োগ ছোট ছিল না। ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও সিইও গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, এই প্ল্যাটফর্মের বিপুলসংখ্যক গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার কী হবে? গ্রাহকরা পণ্য ডেলিভারির জন্য যে আগাম অর্থ পরিশোধ করেছেন, তা কীভাবে তারা ফেরত পাবেন? যেসব মার্চেন্ট পণ্য ডেলিভারি দিয়েছে, তাদের পাওনারই-বা কী হবে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, গ্রাহক ও মার্চেন্ট এবং অন্যান্য সেবা সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা ৫৪৩ কোটি টাকা। অপরদিকে বৃহস্পতিবার র্যাবের হাতে আটকের পর শুক্রবার সংস্থাটির কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের সার্বিক পাওনার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, অথচ ব্যাংকে আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ দেনা পরিশোধের সক্ষমতা বা পাওনা পরিশোধে সমপরিমাণ নগদ অর্থ কিংবা সম্পত্তি কোনোটাই নেই ইভ্যালির হাতে।
ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও সিইওকে আইনের আওতায় নেওয়ার মাধ্যমে ই-কমার্স খাতে বিদ্যমান একটা অনিশ্চয়তা বন্ধ করা হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, এর মাধ্যমে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চয়তার দিকে চলে গেছে। এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। উন্নত দেশগুলোর সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে ই-কমার্স। বাংলাদেশেও ই-কমার্সের সম্ভাবনা অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। বর্তমানে দেশে যে ই-কমার্স সাইটগুলো রয়েছে, সেগুলোর সবই বিশ্বস্ত নয়। তাই ই-কমার্স ব্যবসার দিকে একটা রাষ্ট্রীয় নজর পড়ুক।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস