তাদের চোখে শুধুই অন্ধকার
আমাদের শৈশবে দেখেছি গ্রামে কৃষক পরিবারগুলো সন্ধ্যার পরপরই খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিতো। না, আগে আগে ঘুমিয়ে যাবে সেই জন্য নয়। আসলে বাতি জ্বালানোর কেরসিন তেল সাশ্রয়ের জন্য। তখন আমাদের স্বপ্নে দেখার বিষয় ছিলো- বৈদ্যুতিক বাতি। তারও আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপর ১৭টি জেলা শহরের অধিকাংশ মানুষই দিনরাত বিদ্যুৎ পাওয়ার স্বপ্ন দেখতো। তখন অনেক শহরেই শুধু রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো।
আর বাংলাদেশে? জেলা ছাড়িয়ে থানা পর্যায়ে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্প্রসারণ হতে থাকলো তখন দেখা দিলো আরেক বিপর্যয়। উৎপাদনের ব্যবস্থা না করে শুধু লাইন টানা হলো মাইলের পর মাইল। আর পুরোটাই হলো জনৈক রাজনৈতিক নেতা কাম ব্যবসায়ীর খাম বিক্রি বাড়ানোর জন্য। উৎপাদন রইলো সেই আগের জায়গাতেই।চাহিদা বাড়লো উৎপাদন বাড়লো না। ফলে দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি হলো বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়। লোডশেডিং চলতে শুরু হলো সারা দেশে।সবই জানা কথা। তারপরও মনে আসে মাত্র ১৩/১৪ বছর আগের এমন ভাদ্র মাসের কথা।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি ঘর অন্ধকার। ফ্যান চলে না, তাই হাত মুখ ধুয়ে একটু ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য গেলাম বাথরুমে। গিয়ে দেখি পানি নেই। তারপর হয়তো ক্ষাণিকের জন্য বিদ্যুৎ এলো একসময়,কিন্তু গায়ের ঘাম শুকনোর আগেই আবার হাওয়া। ঘুমোতে যাবো তখন বিদ্যুৎ নেই। ঘরের সামনের এক চিলতে জায়গা ছিলো তখন। সেখানে চেয়ার নিয়ে বসলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের হাত-পা নিজে দেখতে না পেলেও ঢাকাইয়া মশাগুলো ঠিকই কুটুস কাটুস কামড় বসায়। নিস্তার পেতে তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামা।
এই গভীররাতে আমার মতোই অনেক মানুষ তখন পথবাসী। কেউ গেঞ্জি গায়ে কেউ হয়তো খালি গায়ে হাঁটছে গরম থেকে বাঁচার জন্য।ভাব-গতি দেখে মনে হয় কারো কোনো বিরক্তি নেই-হয়তো মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই বলে। সেসব দিনের ফিরিস্তি দিতে গেলে হয়তো ধৈর্য থাকবে না কারো। নাই বা দিলাম তাই।
এবার আসি হাল আমলের কথায়। কয়েকদিন আগে সকাল দশটার পর, বিদ্যুৎ নেই। মাঝে মাঝে এমন হয়। বড়জোর ৪/৫মিনিট পরই চলে আসে আবার। নিচতলায় নামতেই প্রতিবেশির দেখা। কুশল জিজ্ঞেস করতেই চরম বিরক্তির প্রকাশ। রাখঢাক না করে বললেন, এই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। চার তলা থেকে নামতে হয়েছে সিঁড়ি দিয়ে। কারেন্ট না থাকায় লিফট বন্ধ তাই। কী জবাব দেবো এই ডিজিটাল মন্তব্যের?
আসলে তাদের মন্তব্যের জবাব দিয়ে লাভ নেই। যতই বলা হোক-আগে ১২/১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন কাটাতে হতো, এখন কয়েকদিন পর হয়তো ৪/৫ মিনিটের জন্য যান্ত্রিক কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদ্যুৎ যায়। এটুকু সহ্য হয় না এখন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও বিদ্যুতের অভাবে পথে কাটাতো মানুষগুলো। আর এখন সারাক্ষণ বিদ্যুৎ থাকার পরও টিটকারি দিচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে। আসলে তুলনামূলক তথ্য দিলেও কাজ হবে না, তাদের মুখে কখনো কৃতজ্ঞতার শব্দ আসে না এবং আসবে বলেও মনে হয় না।
ওই সম্প্রদায় নিজের চোখে দেখেও স্বীকার করে না, সেখানে তথ্যপ্রমাণ দেখার কথা তো দূরের। যদি তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো- বিএনপি সরকার আমলে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো ২ হাজার ১০৫ মেগাওয়াট।আজকে অবস্থাটা কি? ১২ সেপ্টেম্বরে ৫টি নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র উদ্বোধনকালে তথ্য দেওয়া হয়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। শুধু তাই নয়, ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিলো আজকে এই দেশের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। না এমন বলার কোনো সুযোগ নেই, খাম্বা বিক্রির সুবিধার্থে শুধু তার টানা হয়েছে আর খাম্বা বসানো হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রেরই উৎপাদন ক্ষমতা ৭৭৯ মেগাওয়াট।মোট উৎপাদন সক্ষমতা তো বলাই হলো।
বর্তমান উৎপাদনের পরিমান চাহিদা পূরণে সক্ষম। শুধু তাই নয় ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্যও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং মাদারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর বর্ধিত চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত থাকবে বিদ্যুতের।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে। প্রশ্ন আসতে পারে এখনও সব মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে না। সেইদিকেও নজর দিয়েছে সরকার। মনে থাকার কথা- কয়েকবছর আগেও বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলে দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিতে হতো।আজকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য ভ্যান গাড়িতে সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে বিদ্যুৎ কর্মীরা। পল্লী বিদ্যুৎ এখন পল্লীকে শহুরে সুবিধাদানে তৎপর।
শুধু তাই নয় আগামীতে বর্ধিত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন হবে ৪০ হাজার মেগাওয়াট। ২০৪১ সালের মধ্যে এই উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। অন্তত এটা বলা যায়- প্রতিশ্রুতি পূরণ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আশা করা যায় এগিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, সেটাও পূরণ হবে।
এক্ষেত্রেও একটি পক্ষ কিন্তু সমালোচনা করতে কসুর করবে না। যেমনটি বলা হচ্ছে বর্তমান বিদ্যুৎ সুবিধা বিষয়ে। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করার বিষয়টি নিয়ে তারা সোচ্চার। সত্যি কথা-সাময়িক ব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যয় বেশি। কিন্তু প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এবং অধিক ব্যয়ের কথা চিন্তা করে যদি বিদ্যুৎ ক্রয় না করা হতো তাহলে কি আজকে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ে সেটা সম্ভব হতো?
তারপরও বলতে হবে, অধিক ব্যয় থেকে বাঁচার চেষ্টা সরকার করছে কি না। যেসব মেগা প্রজেক্ট কাজ করছে, সেগুলো তো সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। খুব বেশি দূরে নয়, সরকারি প্রকল্পগুলোই দেশের সামগ্রিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। আবারও বলতে হবে- সাশ্রয়ী মূল্যেই তা সম্ভব হবে।
নিকট অতীতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার পরও তারা সমালোচনা মুখর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পূর্ব পরিকল্পনাগুলো সবই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। এখন তারা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে পারেন। বলছেনও। তারা যা বলছেন, তাকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতূকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অনেকেরই মনে থাকার কথা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কৌতূকের কথা।হুবুহু না হলেও কৌতূকটির মর্মার্থ এমন-
ভানুর প্রতিপক্ষের ছেলে চাকরি পেয়েছে শুনে ভানুর জবাব ছিলো এরকম, চাকরি পেলে কি হবে, জয়েন করতে পারবে না। যখন বলা হলো জয়েন করেছে। তখন সে বলে আরে জয়েন করলে কি হবে, বেতন পাবে না। যখন বলা হলো আরে বেতনও তো পেয়েছে। এভাবে কৌতূকটা চলে আরও কিছুদূর।
তারাও তেমনি সমালোচনা করবেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে কী হবে দেখো এই বিদ্যুত সঞ্চালন হবে না। আর যদি সঞ্চালন সুবিধা বৃদ্ধিও পায় দেখবে সেই বিদ্যুতে বাতি জ্বলবে না। আসলে তারা যে ডিকশেনারি ব্যবহার করে সেখানে শুধু একটি শব্দ আছে। তা হচ্ছে- না। জ্বলজ্যান্ত কিছু দেখার পরও তারা বলবে- দেখি নাই। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস খেতে খেতেও বলবে-বাতাস নাই। প্রায় নিশ্চিত ভবিষ্যত থাকার পরও বলবে, হবে না, না।
লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/জিকেএস