হাতিরঝিলের দূষিত পানি
তেজগাঁও থেকে ফেরার পথে ভাবলাম হাতিরঝিলে যে সব বোট চলছে, সেই পথে বাড়ি যাই। কখনোই ওই রাইডে যাইনি বা আসিনি এদিকে। ওই পথে অন্য যানবাহনে আসা-যাওয়া যখন করি তখনই লেকের নোংরা পানির ততোধিক কালো পানির দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। কুঁচকে যায় নাক-চোখ দুর্গন্ধে। সে সময়ই ভেবেছিলাম হাতিরঝিল নিয়ে লিখবো। রাতেরবেলা দেখতে এতো সুন্দর একটি স্থাপনার জলের কি দশা, ভাবতেই মনটা বিষিয়ে ওঠে।
তেজগাঁওপ্রান্তের কাউন্টার থেকে টিকিট কিনলাম ২০ টাকায়। সেটাই নাকি রেট। মন্দ নয় বোটরাইডিং, ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে যদি সার্ভিসের সেবাটা ঠিক হতো তাহলে তো অনেকেই যানজট এড়িয়ে এই জলযানেই চলাচল করতো। তবে একেবারেই যে করে না, তা তো নয়। অনেকেই এ পথে যাচ্ছে আসছে। উপভোগ করছে নোংরা পানি আর পচা দুর্গন্ধের বাতাসের ঝাপটা। বোটে ওঠার পর চোখে পড়লো কর্তৃপক্ষের একটি নোটিশ। ‘হাতিরঝিল লেকের সৌন্দর্য রক্ষায় ও পানি দূষন [দূষণ] রোধে অনুগ্রহপূর্বক পানিতে সকল প্রকার ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন এবং ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। ধন্যবাদান্তে কর্তৃপক্ষ।’
এটুকু লিখতে কর্তৃপক্ষের ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভুল হলেও যাত্রীরা তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখছে। না দেখলে যাত্রীরা ওই বোট-রাইড ব্যবহার করতো না। কিন্তু প্রশ্নটি অন্য জায়গায়। যে পানি দূষণমুক্ত রাখতে কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের উদ্দেশে ‘আদেশ বা অনুরোধ’ করছেন, সেই পানির মান কেমন তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। যে কোনো মানুষ তা দেখেই বুঝবেন বা বোঝেন। যারা কর্তৃপক্ষের শীর্ষে বসে আছেন, তারা কিন্তু জানেন না আসলেই হাতিরঝিলের পানির মান কেমন। তাদের তো সময় নেই। কিন্তু যারা সরাসরি এই হাতিরঝিল প্রকল্পের সাথে জড়িত, মানে যারা চাকরি করেন হাতিরঝিলের সৌন্দর্য রক্ষায়, তারা কি পানির দুর্গন্ধ পান না? নাকি তাদের নাসারন্ধ বন্ধ? কিংবা হতে পারে তাদের নাকে সমস্যা থাকায় সেই দুর্গন্ধ টের পান না।
যাদের নাকের সমস্যা আছে তারা ওই ঝিলপাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে সন্ধ্যাবেলায় ‘হাওয়া’ খেতে যান। ওই পানির হাওয়া যে দূষণযুক্ত সেটা তারা টের পান বটে, কিন্তু তারা কি করবেন? তাদের কিইবা করার আছে? কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় হাতিরঝিলের সৌন্দর্যে বিমোহিত আশপাশের গরিব ও মধ্যবিত্তবানের চিত্তে যে দোলা দেয়, তাদের পক্ষে কি ভুলেও এ প্রশ্ন তোলা সম্ভব যে, হাতিরঝিলের পানি খারাপ। কিন্তু যারা নোটিশ দিয়েছেন যে ময়লা-আবর্জনা পানিতে না ফেলার, তারা কি জানেন, ঝিলের পানির মান কতোটা নিম্নের? খাওয়ার অযোগ্য তো বটেই, ওই ঝিলে গোসলেরও উপায় নেই। তবু সেদিন দেখলাম, দুজনকে ওই ঝিলে, বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে গোসল করছে।
হাতিরঝিলের পানি দূষণমুক্ত রাখার কথা আমরা সবাই জানি। কর্তৃপক্ষ সেই দায়িত্বে নিয়োজিত। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালন করছেন না। তাহলে কে করবেন? সরকার এসে করে দিয়ে যাবে? সিটি করপোরেশন এসে করে দিয়ে যাবে? আবার এ প্রশ্নও তো উঠে আসতে পারে, এই ঝিলটি কোন সিটির সম্পদ? উত্তরের নাকি দক্ষিণের। তেজগাঁও পয়েন্ট যদি দক্ষিণের হয়, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় গুলশান পর্যন্ত বিস্তৃত লেকটির ওই অংশ উত্তরের। এমনও হতে পারে উত্তর আর দক্ষিণের টানাটানিতে লেকের এ দশা। যে কর্তৃপক্ষ বোটে বোটে নোটিশ টাঙ্গিয়ে ভাবছেন, কর্মশোধ করেছেন, তারা কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। আমি জানি ও দেখেছি হাতিরঝিল প্রকল্পটির নির্মাণকাজ করছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরা। চমৎকার একটি রাস্তার ডিজাইন বাংলাদেশ এই প্রথম দেখলো। দেখলো তার বাস্তবায়নও। সেই সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই হাতিরঝিল এক স্বপ্নপূরণের বাস্তবায়ন। সেই প্রকল্পের পানিটুকু যদি ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে ভালো করা যায় তাহলেই এ নান্দনিকতার যথার্থ মূল্যায়ন করা যাবে।
২.
আরেকটি ছোট বিষয়, কিন্তু মাথাব্যথাটা অনেক টনটনে। রগ ফুলে উঠে বাসিন্দাদের মনে টেনশন তুলে দিয়ে রেখেছে। উত্তর-দক্ষিণের করপোরেশন এলাকা নির্ধারণের জাটিলতায় পড়েছে বনশ্রী এলাকা। এর এক অংশ পড়েছে উত্তরে, অন্য অংশটি দক্ষিণে। প্রশ্নটি হচ্ছে এই সীমা নির্ধারণে এই রকম জটিলতা কেন? বনশ্রীর পুরোটাই যদি উত্তরে বা দক্ষিণের অধীনে দেয়া হয়, তাতে কি এমন সমস্যা তৈরি হবে? আমরা যতোটা মনে করি, কোনো জটিলতাই হবে না। কিন্তু যারা মহানগরে শান্তি ও স্বস্তি আনার যোগানদার এবং যারা সেবা দেওয়ার ওয়াদাকারী, ওই উভয়পক্ষই শান্তি ও ওয়াদা রক্ষার জন্য উদগ্রীব নন, বরং তারা এই মহানগরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ দেওয়ার জন্যই কলম উঁচিয়ে আছেন। যতটা শুনেছি, দক্ষিণ সিটি বনশ্রীর অর্ধেকের বাড়িওয়ালাদের নামে নামে নোটিশ দিয়েছেন হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের। সেই ট্যাক্সের পরিমাণ একেক বাড়িওয়ালার জন্য একেক রকম হলেও তা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। আবার সেই ট্যাক্স দিতে হবে ২০১৫ সাল থেকে।
আমি জানি, আজ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বনশ্রী এলাকার বাড়িগুলোর জন্য কোনো হোল্ডিং নম্বর দেননি। এখানকার বসতিরা ব্যবহার করছেন বনশ্রীর নিজস্ব নম্বর, যা বনশ্রী হাউজিং প্রজেক্টের মালিক [ইস্টার্ন হাউজিং] কর্তৃপক্ষ দলিলের মাধ্যমে ক্রেতাকে দিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, হোল্ডিং নম্বর না দিয়েই কি করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখানকার বসতিদের কাছে হোল্ডিং ট্যাক্স চাইছে? তাও আবার ২০১৫ সাল থেকে, বকেয়া হিসাবে সুদ ও ফাইনসহ। এটা কি সেবার নমুনা? আমরা মাননীয় মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনার ইমেজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কি আপনার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এভাবে ঢিলেমি ও জটিল করে তুলছে গোটা পরিস্থিতি?
সিটির কি কি সেবা আমরা পাই, এ প্রশ্ন করেছেন একজন। প্রতিদিন যে বর্জ্যব্যবস্থা সচল আছে ঢাকা মহানগরে, সিটির লোকেরা প্রতি মাসে প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে ১০০ টাকা করে রিসিট দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। আমরা কি প্রতি মাসেরই সিটির সেবা কিনবো এভাবে? তাই যদি হয় তাহলে সিটির উচিত গার্বেজক্যান সরবরাহ করা। না হলে নোটিশের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ির জন্য কিচেন গার্বেজক্যান, পলিথিন রিসাইকিং গার্বেজক্যান আর কাগজ, বোর্ড, কাচ ও প্লাস্টিকের জন্য আরেকটি গার্বেজ ক্যান কেনার পরামর্শ /নির্দেশ দেয়া উচিত। পশ্চিমা দেশগুলোতে যেভাবে গার্বেজ ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং সেই গার্বেজ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে, নানাভাবে ব্যবহার করা হয়।
পলিব্যাগ রিসাইকিং করে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা দেয়া যায়। আমাদের মহানগরের গার্বেজ কি করা হয় আমি জানি না। একবার মিরপুরের দিকে গিয়ে দেখেছি, সেখানে দুটি বিশাল গার্বেজ স্তূপ পুড়ছে। বিষয়টি আমাদের মনে কৌতূহল তৈরি করেছে। একটি আধুনিক মহানগর গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পনার বাইরে যেনো কোনো বাড়িঘর বা স্থাপনা নির্মিত না হয়, তা দেখতে হবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনকে। তা না হলে ইট-সিমেন্টের বস্তি হিসেবেই বর্ণিত হবে এ মহানগর।
০৯/১০/২১
লেখক : কবি, সিনিয়র সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস