নাসরিনের কান্না ও মানবিক ডিজিএনএম
ইসরাইল আলী সাদেক
নার্সিং পেশার মূল ব্রত মানবসেবা। মানবিক এই পেশায় যারা কাজ করেন তারা নিজেদেরকে সঁপে দেন মানুষের তরে। রোগীর সুস্থতার হাসিতে তারা খুঁজেন তৃপ্তি। কিন্তু এই পেশার সাথে জড়িতদের জীবনের হাসি-কান্নার খবর রাখে না কেউ। মানবতার তরে জীবন উৎসর্গ করে যারা নার্সিং পেশাকে বেছে নিয়েছেন তাদের কান্নার শব্দ পৌঁছে না অন্য কারো কানে। তবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কোভিডের এই কঠিন সময়ে ভাল সময় পার করছেন দেশের নার্সিং সমাজ। আর এর একমাত্র কারণ হচ্ছে বর্তমানে দেশের নার্সিং সমাজের মাথার উপর বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে আছেন একজন মানবিক অভিভাবক। আমাদের সিদ্দিকা আক্তার স্যার। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব)।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স মোছা. নাসরিন নাহার। আমার সহকর্মী। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর তার প্রথম পোস্টিং এই হাসপাতালে। নাসরিনের বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায়। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদানের পর থেকে সে তার নিজ এলাকায় বদলির জন্য অনেক চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু বদলী হয়নি। নাসরিনের স্বামী রাজশাহীতে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। আড়াই বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে পরিবার-স্বজন ছেড়ে বিশ্বম্ভরপুর থাকতে হয় নাসরিনকে। বর্তমানে সে ৮ মাসের অন্ত:স্বত্তা। কঠিন এই সময়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিশ্বম্ভরপুরে চাকুরি করা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় কর্মস্থল হওয়ায় নার্সিং অধিদপ্তরের সাথেও ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পারছিল না সে। সবমিলিয়ে অনাগত সন্তান আর চাকুরি নিয়ে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় সময় কাটছিল নাসরিনের।
কর্মস্থলের ভিন্নতার কারণে নাসরিনের সাথে আমার দেখা হয়নি কোনোদিন। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কারণে সারাদেশের নার্সিং কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ হয়। ভাগাভাগি হয় সুখ-দুঃখ। মাস কয়েক আগে নাসরিন ম্যাসেঞ্জারে নক করে। তার সমস্যার কথা জানায়। নিজ এলাকা রাজশাহীর বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হওয়ার জন্য নার্সিং অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণের অনুরোধ জানায়।
গত সোমবার (০৬ সেপ্টেম্বর) নাসরিন ফের ফোন করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নাসরিনের কান্না শুনে খারাপ লাগে। মনে হয় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে হয়তো এমন আরো কতো সহকর্মী কতো সমস্যা নিয়ে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে। সাহস করে ফোন দেই নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার স্যারকে। মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল নার্সিংবান্ধব স্যার ফেরাবেন না। ফোন দেয়ার পর স্যারের কথা শুনে আমি পুরোই হতবাক। সিদ্দিকা স্যার জানালেন, প্রতিদিনই সারাদেশ থেকে নার্সিং কর্মকর্তাদের নানা সমস্যার আবেদন আসে। সবগুলোই তিনি নিজহাতে গুরুত্বসহকারে দেখেন।
এমনকি যেসব নার্সিং কর্মকর্তারা সাক্ষাতের নির্ধারিত দিনে অধিদপ্তরে যান তাদের প্রত্যেকের সাথে মহাপরিচালক সিদ্দিকা স্যার ও অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন (উপসচিব) স্যার সরাসরি দেখা করে তাদের সমস্যা শুনেন এবং গুরুত্ব বিবেচনায় তা দ্রুততার সাথে সমাধান করেন। তার প্রমাণ পেলাম নাসরিনের বদলির আদেশ দেখে। আমি স্যারের কাছে মানবিক এই বিষয়টি তুলে ধরার পরদিনই (৭ সেপ্টেম্বর) নাসরিনের বদলির আদেশ হয়।
নাসরিন বিশ্বম্ভরপুর থেকে তার নিজ এলাকা রাজশাহীর বাঘায় যাচ্ছে। এক বদলির আদেশ যেন নাসরিনের জীবন বদলে দিয়েছে। চাকরি আর অনাগত সন্তান নিয়ে নাসরিনের জীবনে যে সংকট আর শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, ডিজিএনএম সিদ্দিকা স্যারের এক মহানুভবতায় সেটা যেন পাল্টে গেছে। ফোনে নাসরিন আবারো কাঁদলো। তবে এ কান্না কষ্টের বা অজানা শঙ্কার নয়। এ কান্না আনন্দের, কৃতজ্ঞতার। নাসরিন কাঁদছিল আর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল সিদ্দিকা স্যারের প্রতি। এমন শত শত নাসরিনের আনন্দাশ্রুতে হয়তো লুকিয়ে আছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার স্যারের মহানুভবতা।
আমার কর্মজীবনে তন্দ্রা শিকদার স্যার ও সিদ্দিকা স্যারের মতো এতো নার্সিং কর্মীবান্ধব কর্মকর্তা দেখিনি। বর্তমানে সিদ্দিকা স্যারের নেতৃত্বে যেভাবে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা দেশের যে কোনো সেক্টরের জন্য উদাহরণ হতে পারে। সিদ্দিকা আক্তার স্যারের মতো অভিভাবক মাথার উপর থাকলে প্রান্তিক পর্যায়েরও যে কোনো কর্মী তার জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পিছপা হবে না।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এইচআর/এএসএম