তালেবানের সাথে চীন রাশিয়ার বন্ধুত্ব

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

নতুন এক সংকটের সামনে পশ্চিম এশিয়া। বর্বর শাসনে অভ্যস্ত তালেবানরা দুই দশক পরে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়েছে কিংবা তাদের কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে আমেরিকা। এ লেখা যখন পড়ছেন ততক্ষণে হয়তো আফগান সরকার গঠিত হয়ে গেছে, তাদের দায়-দায়িত্বও বণ্টন হয়েছে। তালেবানরা যে এত দ্রুত পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেবে, তা মার্কিন তথা পশ্চিমা যাবতীয় অংকের বাইরে ছিল। ফলে আজ বিশ্ব কূটনীতিতে এক হতচকিত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নিঃশব্দে পাকিস্তান এবং ইরান, রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে তালেবান নেতৃত্বের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে তালেবানের সাথে সব যোগাযোগ সশব্দে করছে চীন।

আমেরিকা তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরে খুশি। তার বেশি কোনো আন্তর্জাতিক দায় মেটানোর ইচ্ছা বাইডেন সরকারের আপাতত নেই। দুই দশক আগে যখন তালেবানরা বর্বর আচরণ করে বিশ্বকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল তখন রাশিয়া এবং চীনের প্রভাব বিশ্ব পরিস্থিতিতে খুব সামান্যই ছিল। কিন্তু এখনকার আমেরিকাবিহীন আফগানিস্তানে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব অনেক বাড়বে। বিশেষ করে আফগানদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কূটনীতি এবং নিরাপত্তা এই চার ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার দৃশ্যমান অবস্থান দেখা যাবে।

চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের জন্য আফগানিস্তানকে বড় অংশীদার হিসেবেই দেখছে। দেশটি খনিজ পদার্থের দিকে চীনের লোভনীয় চোখ অনেক পুরোনো। একই সাথে আমেরিকা ও ন্যাটোর প্রস্থানের পর রাশিয়া ইউরেশিয়া তথা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী রাশিয়া সংলগ্ন মধ্য এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াবে যেগুলো সোভিয়েতের অংশ ছিল ১৯৯১ এর আগে পর্যন্ত।

মস্কো আর বেইজিং এখন অনেক কাছাকাছি। তাদের নেতারা এটা খুব ভালো করেই বুঝেছেন যে, আফগানিস্তানে তালেবান শাসকদের মেনে নিয়েই এগোতে হবে। তালেবানের কাছে কোনো অন্য উপায় নেই। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত হয়ে কিছুটা ভালো থাকতে হলে চীন ও রাশিয়ার সাথে থাকতে হবে। এমন এক প্রেক্ষাপটে তালেবানরা বারবারই আশ্বস্ত করছে যে, মস্কো বা বেইজিংয়ের স্বার্থ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এমনকি চীনে সংখ্যালঘু মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি চীনের নিষ্ঠুর সব আচরণকেও জায়েজ করতে রাজি তালেবান।

নিকট অতীত অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। তালেবানের পুরোনো ইসলামিক আমিরাত চীনকে শত্রু ভাবতে প্রকাশ্যে। রাশিয়ার বিরোধিতা করতে গিয়ে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। বলতে গেলে সেই সময় চেচেন জঙ্গিদের প্রবাসী সরকারের সদর দফতর ছিল আফগানিস্তান। এসব কারণেই ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিন আফগানিস্তানে বোমাও মেরেছিলেন।

পুরোনো ইতিহাস ঘাটলে শুধু অপেক্ষা করতে হবে সত্যিই আফগানিস্তান চেচেনদের আবার মদত দিতে উদ্যত হবে কি না। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মস্কো আর বেইজিং তালেবানদের বিশ্বাস করছে যে, এরা আগের চেয়ে অনেকটাই আধুনিক কায়দায় দেশ পরিচালনা করবে এবং রাশিয়া-চীনের সাথে সুসম্পর্ক রাখবে।

চীন চাচ্ছে তালেবানশাসিত আফগানকে যেন বিশ্ব সম্প্রদায় পরিত্যাগ না করে। বেইজিং চায়, তালেবান তার অবস্থান পরিষ্কার করুক যে, এই ইসলামিক আমিরাত কোনোভাবেই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে কোনো উৎপাত করবে না। তালেবান এরই মধ্যে সেই প্রতিজ্ঞা করেছে চীনের কাছে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই ল্যাভরভ বলেছেন, রাশিয়া চায় না তালেবানরা মধ্য এশিয়ায় কোনো খবরদারি করুক। রাশিয়া এটাও চায় যে, তালেবানরা আইএসকে কোনো সহযোগিতা করুক। রাশিয়া এটাও চায় যে, তালেবানরা শরিয়া আইনের প্রয়োগ করতে বাড়াবাড়ি না করুক। কাবুল দখলের পর থেকে তালেবানরা যে আচরণ করেছে, রাশিয়া তার প্রশংসা করেছে। তালেবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে, সন্ত্রাস আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। ফলে তালেবানি সন্ত্রাস নিয়ে আপাতত চিন্তিত নয় মস্কো। এমনই আশ্বাস পেয়েছে ইরানও, যাদের একমাত্র চিন্তা তালেবানদের সহিংসতার টার্গেট শিয়া হাজারা সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।

যে মস্কো ২০০৩ সালে তালেবানদের জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল, তারাই এখন তালেবানদের স্বীকৃতি দিচ্ছে আফগানিস্তানের বৈধশাসক বলে। তবে মস্কো ও বেইজিং উভয়ই দেখতে চায় আধুনিকায়নের পথে চলতে যে প্রতিজ্ঞা তালেবানরা করেছে সেটা কতদিন তারা রক্ষা করে। তালেবানরা যতটা শক্ত হাতে দেশ শাসন করতে থাকবে ততই পরিস্থিতি বোঝা যাবে যে, এ তালেবান সেই তালেবান কি না। এ সংশয় সত্ত্বেও রাশিয়া ও চীন তালেবানের ইসলামিক শাসনকে বৈধ হিসেবেই দেখছে।

বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমারাও মনে করছে রাশিয়া বা চীন হয়তো তালেবানদের কিছুটা হলেও সহনশীল ও পরিশীলিত করতে পারবে। একটা ভয়ের জায়গা এখানে যে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করার পরে আফগান ফের পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আমেরিকার অস্ত্রেই এখন বলীয়ান তালেবান। যে অস্ত্র ফেলে গেছে আমেরিকানরা তা এখন তালেবানদের হাতে। যে অস্ত্র, বা গুলি আমেরিকা দিয়েছিল আফগান সরকারকে, সেই বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম দখল করেছে তালেবান। এটা চীন রাশিয়ার কাছে আমেরিকার বড় পরাজয়। তবে বিশ্বের কোনো দেশই দেখতে চাইবে না যে, তালেবানের মাধ্যমে আফগানিস্তান হয়ে উঠছে আল-কায়েদা বা আইএস’র স্বর্গ ভূমি। এমনকি চীন বা রাশিয়াও নিশ্চয়ই নয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম

পশ্চিমারাও মনে করছে রাশিয়া বা চীন হয়তো তালেবানদের কিছুটা হলেও সহনশীল ও পরিশীলিত করতে পারবে। একটা ভয়ের জায়গা এখানে যে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করার পরে আফগান ফের পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আমেরিকার অস্ত্রেই এখন বলীয়ান তালেবান। যে অস্ত্র ফেলে গিয়েছে আমেরিকানরা তা এখন তালেবানদের হাতে। যে অস্ত্র, বা গুলি আমেরিকা দিয়েছিল আফগান সরকারকে, সেই বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম দখল করেছে তালেবান। এটা চীন রাশিয়ার কাছে আমেরিকার বড় পরাজয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।