পরীমনি নারীমুক্তির আদর্শ নয়

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

হেডলাইন পড়েই কেউ কেউ ভ্রু কুঁচকাবেন আবার অনেকেই বাহ! বেশ বলে মুচকি হাসি দিবেন। এই উভয়পক্ষকে মাথায় রেখেই আমি লিখতে বসলাম। আমাদের দেশে একটা সময় ছিলো যখন নারী অধিকার বা নারীমুক্তি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রাম বা মিছিল মিটিং চলতো আর সেগুলো হতো সাংগঠনিকভাবেই। এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এখন নারীমুক্তির আন্দোলনকে দেখা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার লাইনে। সংগঠিত হবার ক্ষমতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি আমরা। এখন আর মহিলা সমিতি বা কোন রাজনৈতিক দলের নারী কেন্দ্রিক কার্যক্রম দেখা যায়না। যা আছে তার সবকটি নামমাত্র টিকে আছে। এরফলে কী দাঁড়াচ্ছে? এখন পুরোটাই হয়ে গেছে ইস্যুকেন্দ্রিক। দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এক একটা ইস্যু আসে তখন একদল দাঁড়িয়ে যায় পক্ষে আবার আরেকদল বিপক্ষে। চলতে থাকে তর্ক বিতর্ক। এর পুরোটাই কিন্তু চলে ফেইসবুক কেন্দ্রিক। ফেইসবুক থেকে রাস্তায় নামার ঘটনা যে একদম নাই তা না তবে সেটির কোন ধারাবাহিকতা থাকেনা। থাকলে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের মামলাগুলো জটলা হয়ে পড়ে থাকতো না দিনের পর দিন।

সাম্প্রতিক পরীমনি ইস্যুতে আবারও আমি নারীমুক্তির আন্দোলনের ইস্যুটিকে সামনে আনতে চাই। পরীমনিকে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছিলো। এর আগে পরীমনি তার উপর ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে নাসির নামে একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো যেই মামলায় নাসির সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো যদিও পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে যান। ঘটনা হচ্ছে পরীমনির সেই অভিযোগের কিন্তু কোন সুরাহা এখনও দেখিনি আমরা।

মনে করা হচ্ছে সেই অভিযোগের বিপরীতে অনেকটা প্রতিহিংসাবশতই পরীমনিকে ফাঁসানো হয়েছে। এত প্রশ্ন উঠতোনা যদি না তাকে গ্রেফতার থেকে রিমান্ড এবং পরবর্তীতে জামিন ইস্যুতে জন্ম নেয়া সন্দেহজনক প্রক্রিয়াগুলো না থাকতো। পরীমনির মুক্তির দাবিতে আমরা কিছু মানুষকে দেখেছি রাস্তায় নামতে। অবশ্যই পরীমনির সাথে যা হয়েছে সেগুলো রীতি মোতাবেক হয়নি। রিমান্ড বা জামিন বিষয়ে আইনজীবীরাই প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে।

পরীমনির সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে বলে আমিও কলাম লিখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একজন পরীমনির গ্রেফতার বা মুক্তির সাথে গোটা নারী সমাজের মুক্তির চিহ্ন খুঁজতে যাওয়াটা কতটা যৌক্তিক? জামিনে বের হয়ে আসার পর পরীমনির হাতে একটি লেখাকে কেন্দ্র করে আমাদের নারী সমাজের অনেকেই তাকে নেলসন মেন্ডেলা, আজকের প্রীতিলতা বা একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে আখ্যায়িত করছে।

অনেকে আবার ভাবছেন পরীমনিই বাংলার আপামর নারীসমাজ। নারীরা আর পিছিয়ে নেই, তারাও লড়তে জানে, বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে জানে বা অপমানে ভীত না হয়ে ফিরে আসতে জানে বলে প্রচার করছেন। আসলেই কী তাই? আসলেই কি এটাই বাংলার নারীর চিত্র? পরীমনির যে জীবনধারা সেটি অবশ্যই তার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় কিন্তু এটি কি কোন আদর্শকে ধারণ করে বা প্রকাশ করে? পরীমনির জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার কতটা আছে? পরীমনি নিজের চেষ্টায় সক্ষমতা অর্জন করেছে। বিলাসবহূল জীবন আয়ত্ত্ব করেছে কিন্তু সেই সুযোগ কি সবার আছে না নেয়ার মত মেসেজ আছে সেখানে?

আমি যখন সামগ্রিক মুক্তির কথা বলবো তখন কিন্তু আমাকে একজন মানুষের জীবনধারার সবটাকেই সামনে এনে বিচার করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কেবল কয়েকটা ঘটনাকে নিয়ে ভাবতে বসলে ভুলটাই হবে বেশি। নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য যেকোন পন্থা অবলম্বনকে সুবিধাবাদিতা বলে লড়াই নয়। খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন পরীর চেয়ে বেশি সাহসী অনেক নারীই আছে আমাদের দেশে কিন্তু সুযোগের অভাবে তারা প্রকাশিত হতে পারছেন না।

নারীমুক্তি মানেই স্বেচ্ছাচারির জীবন নয়। যখন যা ইচ্ছা করলাম সেই জীবন একজন ব্যক্তির জন্য আদর্শ হতে পারে কিন্তু সমাজের জন্য নয়। পরীমনি কি নিজে কখনও নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কোন কাজ করেছেন? কেন তাকে অনুসরণ করবে নারীরা? বাংলা সিনেমার নায়িকা ব্যতিত আর কী পরিচয় আছে তার? যারা প্রীতিলতা নামে আখ্যা দিচ্ছেন তারা কি জানেন একজন প্রীতিলতা কতটা লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে হতে হয়? প্রীতিলতা কেন বিখ্যাত? কেন প্রীতিলতা আজকে স্মরণীয়?

আসলে দেশে বর্তমানে কোন সংগঠিত ফোর্স নেই যারা নারীর ইস্যুতে কথা বলবে বা নারীদেরকে তার অধিকার বিষয়ে সচেতন করবে। কোন কাজই হচ্ছেনা নারী ইস্যুতে। নারীমুক্তির প্রকৃত বিষয়টাই চাপা পড়ে যাচ্ছে এমন ইস্যুভিত্তিক কথায়। আমাদের সামনে কোন আইডল নেই যার জীবনকে আমরা অনুস্মরণ করতে পারি। নারীমুক্তির আন্দোলনের যারা পথিকৃত ছিলেন তাদের নামও ভুলে যাচ্ছি আমরা। আদর্শহীন জীবন কখনও কোন মুক্তিকে আনতে পারেনা।

পরীমনির পক্ষে কেবল একটা জায়গাতেই কথা বলার আছে সেটি হচ্ছে একজন নাগরিক হিসেবে তিনি তার প্রাপ্য অধিকারটুকু পাননি। এর বেশি আর কোন পয়েন্ট থাকতে পারে না। আমি হয়তো এই লেখাটি লেখতাম না। কিন্তু বাধ্য হয়েই লিখলাম কারণ আমরা জেনে হোক বা না জেনে হোক মিডিয়া থেকে শুরু করে সাধারণ সচেতন অনেকেই পরীমনির সাহসিকতাকে আইডল হিসেবে দাঁড় করিয়ে নারীর অধিকার আন্দোলনকে দুর্বল করে দিচ্ছেন। আমাদের মিডিয়ারও শিক্ষার দরকার আছে কাকে কেন আইডল করবো আর করবো না?

একজন বিচ্ছিন্ন নাগরিকের অধিকার আর গোটা একটি গোষ্ঠির মুক্তির অধিকার কখনও এক হতে পারে না। এ বিষয়টি গুলিয়ে ফেললে বেগম রোকেয়া থেকে সুফিয়া কামাল সবার সাথে অন্যায় করা হবে। পরীমনি যদি তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে নারী সমাজের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারে তাহলেই হয়তো আমরা বলতে পারবো পরীমনি আগামীর নারী জাগরণের একজন কর্মী। অন্যথায় সমাজের কাছে ভুল বার্তাই যাবে।

লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

নারীমুক্তি মানেই স্বেচ্ছাচারির জীবন নয়। যখন যা ইচ্ছা করলাম সেই জীবন একজন ব্যক্তির জন্য আদর্শ হতে পারে কিন্তু সমাজের জন্য নয়। পরীমনি কি নিজে কখনও নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কোন কাজ করেছেন?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।