তালেবানের পুনরুত্থান: কী বার্তা দিল জাতিসংঘ
যুক্তরাষ্ট্রের তড়িঘড়ি করে কাবুল ত্যাগ ও তালেবান বাহিনীর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে দীর্ঘ দিনের ক্ষমতা ও রাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটে গেল। এ ঘটনাকে শুধু আফগানিস্তানের ক্ষমতার পরিবর্তন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। আফগানিস্তানে এই অভিযানের সঙ্গে জড়িত ছিল বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পর মার্কিন বাহিনীও আফগানিস্তানে একই পরিণতি বরণ করে নিয়েছে।
আপাতত এই ঘটনাকে বিশ্ববাসী হয়তো শুধু পেন্টাগনের পরাজয় হিসেবেই দেখছে। কাবুল থেকে খালি হাতে প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় যেমন বইছে তেমনি এতদিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও সবাই কথা বলতে শুরু করেছে। নিউক্লিয়ার উইপন, মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতিগঠন-এই সবই কি তবে দেশে দেশে মার্কিন আগ্রাসনের অজুহাতমাত্র। আফগানিস্তানে জঙ্গি দমনের কথা বলে জাতিগঠনের অজুহাতে দুই দশক ধরে সেখানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে অবশেষে সেই জঙ্গিদের হাতেই আফগানিস্তানকে তুলে দিয়ে কী বার্তা দিল যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘই বা কী বার্তা দিল।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘ তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। জাতিসংঘ পরাশক্তিগুলোর বেঁধে দেওয়া সুরেই কথা বলে একথা আমরা জানি। গা বাঁচাতে জো বাইডেন তো ইতোমধ্যে নানা সাফাই গাইতে শুরু করেছেন। আফগানিস্তান ছাড়ার একটি অজুহাত হিসেবে তিনি বলেছেন যে তারা সেখানে কোনো বিদ্রোহ দমন করতে যাননি। শুধু জঙ্গি দমনের জন্য সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশকে তারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পয়সা খরচ করে দুই দশক পরে সেই জঙ্গিদের হাতেই আফগানিস্তানকে তুলে দিয়ে দেশে ফিরেছেন। এখন বলছেন, আফগানিস্তানে জঙ্গি দমন হয়েছে, তাই তারা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তাহলে এতদিন যারা জঙ্গি ছিল, তারা কি ভালো হয়ে গেল? জঙ্গি হলো বিদ্রোহী।
এতদিন শুনেছি তালেবানরা জঙ্গি। আজ জো বাইডেন বলছেন তারা বিদ্রোহী। জঙ্গিদের নাকি অনেক আগেই তারা দমন করেছেন। যদি ২০০১ সালের যুদ্ধেই জঙ্গি দমন হয়ে থাকে তবে এতদিন তারা আফগানিস্তানে কী করেছেন? জো বাইডেন এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি আগ বাড়িয়ে আরও বলেছেন যে আফগানিস্তানের জাতি গঠন কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আমেরিকার কাজ নয়। এ কি কথা? এতদিন শুনেছি শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বব্যাপীই জাতিগঠন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাদের ওপর ওয়াজিব। এখন শুনছি এটা তাদের জন্য জায়েজও নয়। যদি তা নাই হয় তবে কেন ছিল এই সৈন্য সমাবেশ? এ সব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, না জাতিসংঘের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই এখন জাতিসংঘের ওপর দায় চাপাবে। তারা যা করেছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালের বন চুক্তির (Agreement on Provisional Arrangements in Afghanistan Pending the Re-Establishment of Permanent Government Institutions) অজুহাত দেবে এটাই স্বাভাবিক। এই চুক্তির বদৌলতেই যুক্তরাষ্ট্র তথা জাতিসংঘ আফগানিস্তান পুর্নগঠনের কাজ শুরু করে। কিন্তু ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগেই যে আফগানিস্তানের ওই যৌথ অভিযান সেটা সবারই জানা। আফগানিস্তানে এর আগের দুই দশক ধরেই (১৯৭৯ সাল থেকে) জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সরকার ছিল না। কিন্তু অভিযান হয় ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরে।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সময়ের তালেবান সরকারকে nationally agreed-upon government হিসেবে স্বীকার করতো। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে একটি স্থায়ী nationally agreed-upon government প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে এটাই ছিল ম্যান্ডেট। জাতিসংঘকে এরকম একটি সরকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে অর্ন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব পালন করার কথা। জাতিসংঘের এ অর্ন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ই সেখানে আমেরিকান ও উত্তর আমেরিকান যৌথবাহিনী (ন্যাটো) আফগানিস্তান কব্জা করে নেয়। দুই বছরের ম্যান্ডেট নিয়ে কুড়ি বছর থেকে যায়। কুড়ি বছর পরে যে সরকারের হাতে তারা ক্ষমতা দিয়ে চলে গেলো সে সরকারকেও nationally agreed-upon government না বলার কারণ থাকতে পারে না। তারা তা বলছেও না। এমনকি জঙ্গিও বলছে না। না যুক্তরাষ্ট্র, না জাতিসংঘ। বলছে বিদ্রোহী।
স্মর্তব্য, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই সেদিন বন কনফারেন্স হয়েছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই ২৫ সদস্যের একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল। সরকার গঠনের পাশাপাশি জাতিসংঘ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে একটি রেজুলেশন গ্রহন করে। ১৩৮৬ নং রেজুলেশনের মাধ্যমে তারা আফগানিস্তানে একটি ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়তা বাহিনী বা International Security Assistance Force (ISAF) গঠন করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে দিয়ে ওই রেজুলেশন পাস করিয়েই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। কাজেই জাতিসংঘের দায় এড়ানোর সুযোগ আছে কি?
বনচুক্তির প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছে আফগান জাতি গঠনের কথা। এ চুক্তির স্বাক্ষরদাতা ও সাক্ষীরা এ কথা অস্বীকার করবে কিভাবে? চুক্তির ভিত্তিতে জাতি গঠন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করাই ছিল ওই চুক্তির মূল কথা। ওই চুক্তির সর্বশেষ সদস্য তথা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন লাখদার ব্রাহিমী। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি।
আমরা জানি, দীর্ঘ দুদশকেও বন চুক্তির কোনো ইতিবাচক বাস্তবায়ন হয়নি। এ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ন্যাটো বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে, কিন্তু এই চুক্তির কোনো ইতিবাচক ফল আফগানিস্তান পায়নি। সেখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়নি, প্রশাসনিক সংস্কার হয়নি, তালেবানও দমন হয়নি। এ দায় জাতিসংঘ এড়াতে পারে কি?
যুক্তরাষ্ট্র বা কোনো পরাশক্তিকেই প্রভাবিত করার মতো কোনো ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। আফগানিস্তানেও জাতিসংঘের সে ক্ষমতা ছিল না। শুরু থেকে জাতিসংঘ আফগানিস্তানে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। জাতিসংঘ নিজেরা তো কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেনি অন্যদিকে আমেরিকান সামরিক বাহিনী চুক্তিও রেজুলেশনের এজেন্ডার বাইরে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে গেলে তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কিন্তু ঘটনাক্রমে কোনো আমেরিকান সৈন্য নিহত হলে জাতিসংঘ সেখানে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলতে বিলম্ব করতো না। কারণ, এটি করতে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, কারো চোখ রাঙানির ভয় নেই।
জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা অর্জনের জন্য যতোটা চেষ্টা করেছে সে অনুপাতে যদি আফগান জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করতো তবে দেশটি হয়তো গণতন্ত্রের পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারতো। জাতিসংঘ ন্যাটোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেনি। কিন্তু জাতিসংঘকেই বা কে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে?
১৫ আগস্ট কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হলো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ন্যাটো বাহিনীর আফগান অভিযান। দুই দশকে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনো মানোন্নয়ন হয়নি। দুই দশক পরে জাতিসংঘ বাহিনীর বিদায় বেলায়ও আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নিয়ে তারা কোনো মাইলস্টোন দিয়ে যেতে পারেনি। ফলে, জাতিসংঘ আফগানিস্তানকে শেষমেষ তালেবানের হাতেই ছেড়ে দিয়ে গেছে।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘ যে কাজ করতে পারেনি এখন ভিন্ন মোড়কে আফগান জনগণের ওপর যাতে দুর্দশা নেমে না আসে তার উপায় খুঁজছে জি-৭। জি-৭ নেতারা তাদের গৃহিত পরিকল্পনা আবার কার্যকর করবে জাতিসংঘকে দিয়েই। প্রস্তাব পাস করার জন্যতো নিরাপত্তা পরিষদ আছেই। তবে নিরাপত্তা পরিষদে জি-৭ নেতাদের নেওয়া এজেন্ডা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস নাও হতে পারে। কারণ, জি-৭-এ চীন ও রাশিয়া নেই। আর বর্তমানে আফগানিস্তান প্রশ্নে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্নতর।
কাজেই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে শুধু জি-৭ নয় অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও তালেবান সরকারকে পুরোপুরি স্বীকৃতি না দিলেও তাদের সঙ্গে বিরোধিতায় জড়াবে না। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যদি সেখানে নতুন করে সামরিক শক্তির মহড়া শুরু হয় বা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় সেটি ভবিষ্যতে সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তান প্রশ্নে বৈশ্বিক ক্ষমতার এক ধরনের পালাবদলের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সেটি কতটুকু দীর্ঘমেয়াদী হবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘও নিজেদের ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুধু আফগানিস্তান একাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়নি, কাঁধে করে নিয়ে গেছে জাতিসংঘের কফিন। তবে আফগানিস্তান প্রশ্নে জাতিসংঘের কফিনে শেষ পেরেকটি এখনও ঠোকা হয়নি। ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে জাতিসংঘ কী ভূমিকা পালন করে তার ওপরই নির্ভর করে এ প্রশ্নের জবাব। এখনও জাতিসংঘের সুযোগ রয়েছে সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করার। একটি টেকসই রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠন, উন্নয়ন ও সংস্কারে জাতিসংঘ তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গেই কাজ করে যেতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম