‘সেপ্টেম্বর’ হোক শেখ হাসিনার শাসন মূল্যায়নের বিশেষ মাস
২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। এই সেপ্টেম্বর মাসটি হোক তাঁর শাসনকালের নিবিড় মূল্যায়নের মাস। সারা বছরই বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি দেশ-বিদেশে আলোচিত হচ্ছেন কিন্তু তাঁর জন্ম মাসটিকে আমরা বিশেষ তাৎপর্যে অভিষিক্ত করতে চাই। সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের ‘মহান শিক্ষা দিবস’ পালিত হয়, যার সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক আছে; আছে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’; যা তাঁর সরকারের মূল্যবান অর্জন হিসেবে গণ্য। আরো আছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস। যিনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মাহুতি দেন এ মাসেই।
সব মিলে ত্যাগে, অর্জনে ও সাফল্যে একটি মহিমান্বিত মাস হলো ‘সেপ্টেম্বর’। ‘সেপ্টেম্বর’ বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাস। কারণ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ ১৮ বছর চলমান শেখ হাসিনার শাসনকাল। এ মাসে তিনি না জন্মালে আমরা থাকতাম অন্ধকারে; সুশাসন পেতাম না। তাঁর জন্ম মাস এজন্য আমাদের কাছে কল্যাণকর ও মঙ্গলময়। তবে বাকি আছে তাঁর শাসনকালের ভবিষ্যতের দিনগুলো। এখন প্রয়োজন ‘শেখ হাসিনা শাসনকালে’র বিশ্লেষণ। দেখা দরকার এদেশের অগ্রগতিতে এই শাসনকাল কতটা ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে তাঁর নেতৃত্ব কতটা কার্যকর হয়েছে; সুবাতাস বয়ে এনেছে এদেশের জনগণের অন্তরে?
গত ১৮ বছরে জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণে দু’একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়। প্রথমত : শেখ হাসিনা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিসম্পৃক্ত। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠীরা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, হাসিনার ছিল একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা, সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশতে পারতেন। একেবারে সহজ-সরল আন্তরিকতায় ভরা মন। সবার মন জয় করার একটা মুগ্ধময় ক্ষমতা ছিল তাঁর। বেবী মওদুদ লিখেছেন, ‘তার সঙ্গে আমার মনের মিল ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে বই পড়া, গান শোনা, আড্ডা, সভায় মিছিলে যাওয়া এবং ছাত্র রাজনীতির কাজকর্ম করা। যদিও দু’জনে দুই সংগঠনে তারপরও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ট ছিল। তার কথাবার্তা, চিন্তা ভাবনার সঙ্গেও তখন থেকে আমি সহমর্মী হই। তার জনদরদী মন আছে যা আমাকে স্পর্শ করে থাকে। তার প্রথম পছন্দ বই পড়া। বই উপহার পেলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়ে থাকেন। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক নেতা এবং অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’
পিতার রাজনৈতিক আদর্শ, আন্দোলন-সংগ্রাম-কারাবন্দী জীবন সবই তিনি শৈশব-কৈশোর থেকেই দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে পিতার আদর্শ উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি যখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তখন নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। এসময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিল। এরপর ঢাকার উচ্চ মাধ্যমিক মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে কলেজের ছাত্রীদের সমস্যা সমাধান ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা লেখা আছে শেখ হাসিনার নিজের রচনায়। ‘আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ছিল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আন্দোলন করার জন্য। ছাত্র রাজনীতির এই ঐতিহ্য নষ্ট করার জন্য এবং আইয়ুব খানের আমলেই ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রধারীদের মহড়া শুরু হয়। মেধাবী গরিব ছাত্রদের অর্থ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি ধ্বংসের এই চক্রান্ত আজও বিদ্যমান।’(স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতিকথা, সাদা কালো)
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। দ্বিতীয়ত : ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি বলেছেন- ‘আমার একমাত্র দায়িত্ব পিতার অধরা স্বপ্ন সফল করা।’ শেখ হাসিনা প্রায়শ বলে থাকেন, ‘জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই আমার রাজনীতি।’ শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে ভালোবাসেন, ‘শিশুরা আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে তাদের ভবিষ্যতকে আনন্দ, উজ্জ্বল, স্বস্তি ও শান্তিময় করে তুলতে হবে।’
তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন ও সংগ্রাম, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার প্রবক্তা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে তাঁকে বিশেষভাবে শান্তি পুরস্কার ও সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তাঁর শাসনকালে দেখা গেছে যে কোনো সংকট মুহূর্তে কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৮২ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তিনি প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশ, সহকর্মীদের শত বাধা এবং সুশীল সমাজ কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর বিপক্ষে থাকার পরও তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং পরবর্তীতে আবার সংসদ থেকে বের হয়ে আসা একটি বিশাল ব্যাপার ছিল। ১৯৯১ সালের পর বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে সফলতা, ১৯৯৬ সালের সরকার প্রধান হিসেবে সাফল্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; তেমনি ১/১১’র প্রেক্ষাপটে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনন্যসাধারণ।
সব শেষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি তিনি করেছিলেন দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে- বিরোধী পক্ষসহ তাবৎ দুনিয়ার ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশক্তির হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। এজন্য তাঁর উপলব্ধি তাৎপর্যবহ-‘বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান আমাকে দিতেই হবে। জনগণের জন্য একটা সুন্দর, উন্নত জীবন উপহার দেব, এই আমার প্রতিজ্ঞা।’(সবুজ মাঠ পেরিয়ে, সবুজ মাঠ পেরিয়ে)
২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হওয়ার পর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। এমনকি হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা-অত্যাচার নির্মূল করা হয়েছে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বিদেশী রাষ্ট্রের ক্রমাগত অভিনন্দনে মুখরিত এখন বাংলাদেশের প্রতিটি আঙিনা; অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বিস্ময়করভাবে আমরা লক্ষ করলাম যে সব ব্যক্তি নির্বাচনোত্তর সমালোচনায় মুখর ছিলেন তারা এখন সরকারের গুণগানে আলোড়িত; টিভির টকশো’তে তারা বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৃতিত্বে আনন্দিত। তবু অপপ্রচার থেমে নেই। এখনো ভারত বিরোধী সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে; অপপ্রচারের অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে জামায়াত-বিএনপির হাতে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে মনে করছে জামায়াত-বিএনপি। দেশ-বিদেশে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিচিত্র অপপ্রচার বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্তিতে ফেললেও আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা পুনর্বহাল হতে দেখা গেছে বারবার।
দেশ ও জাতির কল্যাণের স্বার্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একটি সুন্দর সমাজ পায়। একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ আমরা সকলে মিলে গড়ে তুলতে পারি। সকল ভেদাভেদ ভুলে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষে গড়ে তুলি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক বাংলাদেশ, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা- এই প্রত্যাশা শেখ হাসিনার সবসময়ের জন্য। আর এজন্যই ‘সেপ্টেম্বর’ মাস হোক তাঁর শাসনকাল মূল্যায়নে স্বতন্ত্র ও গুরুত্ববহ একটি মাস।
লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
এইচআর/জেআইএম