বেখবর বান: অদেখা ত্রাণ

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১

কমছে কম দেশের ১২ টি জেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে আছে বানের পানিতে। পরিস্থিতি কেবলই অবনতির দিকে। উত্তর, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের এই জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আভাস দেয়া হয়েছে। উজানে ভারি বর্ষণ চলতে থাকায় কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটছে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উত্তর-মধ্যাঞ্চলের জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা; মধ্যাঞ্চলের মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, শরিয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি করুণ। আটটি নদীর পানি ১২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে। পদ্মার পানি সুরেশ্বর ও গোয়ালন্দ পয়েন্টে, মেঘনা নদীর পানি চাঁদপুরে বিপদমার উপরে। যমুনার পানি ছয়টি পয়েন্টে বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। আরিচা, মথুরা, সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর, সারিষাকান্দি, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমা পেরিয়ে উপচে পড়ছে। কোথাও কোথাও নদী ভাঙনও তীব্র রূপ নিয়েছে। ভাঙ্গনে প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে বসত ভিটাসহ ফসলি জমি।

দুর্গত এলাকার অনেক ঘরে কোমর পানি। রাত জেগে বসে থাকতে হয়। রান্নার চুলাও পানির নিচে। টিউওয়েব তলিয়ে গেছে। বাথরুম আর বানের পানি একাকার। ঘর ছেড়ে সরকারি রাস্তা বা কোনো উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়াদের দুর্ভোগ সরেজমিনে না গেলে বোঝার মতো নয়। কিন্তু, গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর কম। থাকলেও ট্রিটমেন্টে বেশ ঘাটতি। এমন কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই ছাপ। যেখানে যাচ্ছেতাই বিষয়ে আহ-উহর এন্তার ছড়াছড়ি। ঝোক বেশি হেলেনা-পরীমণিতে। এটাই নিদারুন এক বাস্তবতা।

বন্যাকবলিতদের পাশে দাঁড়ায়নি কোনো সংস্থা। বন্যার খবরের দুর্বল ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় ত্রাণের ঘটনাও নেই। নিজের নাম প্রচারের জন্য হলেও ত্রাণ নিয়ে মানুষের কাছে ঘেঁষা, ফটো সেশন করার লোকও যেন উধাও। করোনাভাইরাসের সংকট কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি একটু একটু ঘুরে দাঁডাচ্ছে। ভূ-ভাগের বিভিন্ন জায়গা দীর্ঘ সময় বন্যার পানিতে ডুবে থাকলেও কৃষিখাত ভালো করছে। ইতিবাচক এসব চিত্র তুলে আনতে পারলে পেশাগতভাবে অন্যরকম আনন্দ অনুভব হতে পারতো। চারদিকে নানা নেতিবাচক খবর, দুর্নীতির নানা অবিশ্বাস্য কাহিনীর কষ্টের সময় ইতিবাচক খবর আন্দোলিত না করে পারে না। রাজনীতি-অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যার খেলা থাকে। সংখ্যার ভেলকিও থাকে।

হিসাবের নানা মারপ্যাঁচেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি। অঙ্কের হিসাবে অনেক কিছু মেলে না। মিলবে না। বন্যায় আক্রান্ত কতো মানুষ, ক্ষয়-ক্ষতি কতো, করোনার টিকার জন্য খরচ হয়েছে কতো?- এসবের হিসাব জানতে চাওয়া অপরাধ নয়। আবার পাই টু পাই হিসাব কখনো পাওয়ায় যাবে না। তাই বলে কী হিসাব নেয়ার চেষ্টা থাকবে না? করোনার ভয়াবহতা, মৃত্যু-আক্রান্ত-শনাক্তের রেকর্ডও প্রতিদিন ভাঙছে। কম-বেশি হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে টিকার ঘাটতি যে আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে, তা তো কিছু হিসাব ও জিজ্ঞাসার ফল। এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যের কমতি নেই। কিন্তু বন্যার খবরের তথ্য কেন পেছনে পড়ে যাবে?

পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে ওঠেনি। ফেনীর ফুলগাজী-পরশুরাম উপজেলার তিনটি পয়েন্টে ভেঙে ১০-১২টি গ্রামের হাজারো মানুষের পানিতে জীবন-জীবিকা নির্বাহের খবর মফস্বল খবরের পর্যায়ে। নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার গ্রামকে গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার খবরের ট্রিটমেন্টও দুর্বল। হতে পারে করোনার মতো মুসিবতের তুলনায় বড় বিপদ না হওয়ায় খবরের এমন তারতম্য।

বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকায় ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মৌসুমি বায়ুর উথাল-পাথাল অবস্থা। তা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ ও নাটোর জেলার জন্য অ্যালার্মিং। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানির সমতল বৃষ্টিপাত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সেখানে পানি বাড়তে থাকলে লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা নিশ্চিত। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি নেমে এসে পদ্মায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এতে রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে। অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল আর উজান থেকে আসা পানি বাংলাদেশে বন্যার অন্যতম কারণ। সাধারণত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকা বন্যার উৎস।

দিনপঞ্জিকায় এখন বর্ষাকাল। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালের সময়টায় বৃষ্টিবাদল কমবেশি হয়েই থাকে। এবারেই যেমন পহেলা আষাঢ় থেকে প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে বৃষ্টিপাত। গ্রীষ্মের প্রখরতায় অতিষ্ঠ জনজীবনের কাছে বৃষ্টির শীতলতা অনেকটাই পরম আকাক্সিক্ষত। কেবল নদীঘেঁষা এলাকা নয়, রাজধানী ঢাকাও সুরক্ষিত নয়। রাজধানীতে মাঝারি বৃষ্টিও মিনি বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিই রাজধানীর পথঘাট তলিয়ে দিচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতে সড়কের সেই জলাবদ্ধতা খুব বেশি সময় স্থায়ী না হলেও ভারি বৃষ্টিপাত মানেই সড়কে পানির স্থায়িত্বের মেয়াদও বেড়ে যায়। চুরি যাওয়া ম্যানহোলের ঢাকনায় উল্টে পড়ে রিকশা-ট্রাকসহ মানুষজন। করোনায় মৃত্যু, আক্রান্ত, শনাক্তের তথ্য শীর্ষসংবাদ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার এ দশাও খবরের জগতে এবার গুরুত্ব পাচ্ছে কম।

স্মরণ করতে হয় গেল বছরও করোনার মধ্যপথে বন্যার হানা ছিল। তখন করোনার থাবা এবারের পর্যায়ে ছিল না। করোনার থাবা ছিল তখন ৩১টি জেলায়। এবারের পরিস্থিতিতে অনেক তফাত। তার ওপর এবার নদী ভাঙনের শঙ্কাটা ব্যাপক। বেশ আগেভাগেই এবারের বর্ষায় নদীভাঙন তীব্র হওয়ার আভাস দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস। তাদের পূর্বাভাস ফলতে শুরু করেছে।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশে নদীভাঙন কম ছিল। এমনকি চাঁদপুর, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়ার মতো তীব্র ভাঙনপ্রবণ এলাকায়ও ভাঙন অনেকটা কমে যায়। কিন্তু ২০২০ সালে এসে পরিস্থিতি আবার পাল্টাতে থাকে। যমুনা ও পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীর তীর এলাকার মানুষের কাছে বন্যার চেয়ে আতঙ্ক বেশি ভাঙন নিয়ে। তার ওপর করোনার থাবায় বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে একট বড় জনগোষ্ঠী কর্মহীন। বিপদের ওপর আপদে তারা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

যমুনা ও পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীর তীর এলাকার মানুষের কাছে বন্যার চেয়ে আতঙ্ক বেশি ভাঙন নিয়ে। তার ওপর করোনার থাবায় বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে একট বড় জনগোষ্ঠী কর্মহীন। বিপদের ওপর আপদে তারা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।