নৌকাডুবি : লইছকা বিল ও ভূ-মধ্যসাগর
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের তিতাস নদরে লইছকা বিলে গত ২৮ আগস্ট তারিখে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বালুবাহী ট্রলারের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌকার মুখোমুখি সংর্ঘষ হয়। এতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দেশে নৌ দুর্ঘটনা কমছেই না। দেশের নদী, সাগর, খাল-বিলে যেমন নৌ-দুর্ঘটনায় প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর শোকাবহ সংবাদ মেনে নেয়া যায় না, তেমনি বাংলাদেশীদের নিয়ে বিদেশের সাগরে ঘন ঘন নৌকাডুবির ঘটনা সারা পৃথিবীকে আমাদের সম্পর্কে কি মেসেজ দেয় তা বড় ভাবনার বিষয়।
লইছকা বিলে ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে শতাধিক যাত্রী ছিলেন। সবাই জেলা শহরে যাচ্ছিলেন। এত ছোট নৌকায় এত মানুষ উঠেছিল যে কারো ঠিকমত পা ফেলার জায়গা ছিল না। এত ছোট নৌকাকে কেন ট্রলার বলা হয় তা মোটেও বোধগম্য নয়। গভীর পানিতে যাবার পর সবার নড়াচড়ায় নৌকার দুলুনিতে এপাশ ওপাশ কাত হতে থাকে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসায় যাত্রীরা ভয় পেয়েছিলেন। তাই তাদের হুড়োহুড়িতে একসময় দ্রুত পানিতে তলিয়ে যায় নৌকাটি।
এই নৌকায় ছিলেন আরিফ বিল্লাহ (২০)। পরিবারের বড় ছেলে ছিলেন তিনি। এ বছর ঢাকা গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। পরিবারের স্বপ্নও ছিল আরিফকে ঘিরে। লইছকা বিলের নৌকাডুবিতে আরিফের মৃত্যু যেন পরিবারের স্বপ্নকেও ডুবিয়ে দিল।
আরিফ বিল্লাহ শক্তিবান সামর্থ্যবান শরীরের পুরুষ। তিনি অনেককে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি জানান, আরিফকে জাপটে ধরে অনেকেই বাঁচতে চেয়েছিলেন। শেষে তাঁর জীবনই যায় সবার আগে। আরিফের বাড়ি উপজেলার চম্পকনগর গ্রামে। বাবা জহিরুল হক ভূঁইয়া আর মা পারভীন ভূঁইয়া সৌদি আরব প্রবাসী। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরে আসছেন তাঁরা।
একটি পত্রিকা লিখেছে, “আরিফের বাবা ও দুই চাচা সৌদি আরবের দাম্মাম নগরে ব্যবসা করেন। যৌথ পরিবার। দুই চাচা দেশে এসেছেন। দাদা মনিরুল ইসলাম, বড় চাচা ওমর ফারুক (৩৫) ও ছোট চাচা বোরহান উদ্দিন (৩০) বিলাপ করছিলেন। আর বলছিলেন, সবার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল একমুহূর্তের মধ্যে। আরিফের নিকটাত্মীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাহরিয়ার ইসলাম (২০) বলেন, দুদিন আগে তিনি ও আরিফ সিলেট থেকে ঘুরে আসেন। শুক্রবার আরিফ এক বন্ধুকে ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার জন্য জেলা শহরে যাচ্ছিলেন। সেই যাওয়াই সব শেষ করে দিল।”
নদীর দেশ, হাওড়-বাওড়, বিলের দেশ বাংলাদেশে প্রতিদিন কত নৌকা, ভেলা, স্পিডবোট, লঞ্চ, জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। শুধু বড় বড় নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হলে গণমাধ্যমের বদৌলতে সেগুলো দেশের মানুষ জানতে পারে। লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি আমাদের দেশে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এট গা সওয়া হয়ে গেছে। তবুও মানুষ মোটেও সতর্ক নয়।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রধান কারণ, অসম প্রতিযোগিতা করে লঞ্চ চালানো। অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ চালক প্রায়শঃই লঞ্চ ভর্তি মানুষের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে মাঝ নদীর উত্তাল স্রোতের মধ্যে। তারা দুর্যোগের সময় আবহাওয়া বার্তা পড়ে না, শোনে না, মানে না এমনকি মহাবিপদ সংকেতকে তোয়াক্কাও করে না।
চৈত্র মাসে স্বল্প পানিতে লঞ্চডুবি ঘটায় আবার বর্ষার সময় নদীতে এত প্রশস্ত জায়গা থাকতেও আরেকটি জলযানকে ধাক্কা দেয়, পাল্লাপাল্লি করে চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। নৌ-দুর্ঘটনা আমাদের অজ্ঞতার সাথে নদীপথে চলার বিপজ্জনক সঙ্গী হিসেবে সাথে চলে জীবনভর।
একটি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে গেলে হৈ-হৈ, রৈ-রৈ রব উঠে। কেউ প্রেপ্তার করে, কেউ স্বজনের লাশ খঁজে বেড়ায়, কেউ ভিকটিমের আত্মীয়কে ক্ষতিপূরণের জন্য টাকা দিতে দৌড়াদৌড়ি করে। কেউ রাজনীতি শুরু করে, কেউ বড় বড় বক্তৃতা দিতে টক শো মাতিয়ে তোলে। তারপর সব নীরব, দু’দিন বাদে সবকিছু সুনশান। সড়ক দুর্ঘটনার বেলাতেও অনুরুপ ঘটনা ঘটে।
বর্ষাকালে আমাদের দেশটাকে আকাশ থেকে দেখলে সাগরের মত মনে হয়। অথচ, গ্রীষ্মকালে পানির অভাবে সেই মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বর্ষার বাংলাদেশ যেন গোটাটাই বঙ্গোপসাগর। বিল- হাওড়-বাওড়ে বাতাসে ঢেউ উঠলে ছোট নৌকা, ট্রলারকে সামলানো দায় হয়ে উটে। সে সময় বেশী নৌকাডুবি ঘটে। কয়েকদিন আগেই বরযাত্রীসহ নেত্রকোনার হাওড়ে নৌকাডুবি ঘটে অনেকের প্রাণহানি হলো। শতিলক্ষ্যা নদীতে বার্জের সাথে ধাক্কা লেগে অনেকের প্রাণ গেল।
এসব অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। ক্ষতিপূরণও আছে, কিন্তু সেটা কার পকেটে যায় তা বোধগম্য নয়। দায়ী ট্রলার বা বার্জ রাতারাতি রং বদলিয়ে পুনরায় রুটে চলতে থাকে যেন কাদের অঙ্গুলির ইশারায় ! আমাদের দেশে ঘুষ-দুনীতি, চোর-বাটপারে ভর্তি সব সেক্টর হওয়ায় এজন্য কোথাও কোন ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ে না।
তা না হলে প্রতিবছর আমাদের দেশের সোনার ছেলেরা ধানের দেশ, গানের দেশ ছেড়ে কেনই বা অবৈধ পথে দেশের বাইরে চলে যেতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারায়- বিদেশের নদী ও সাগরে? সাম্প্রতিক সময়ে ভূমধ্যসাগর, তিউনিশিয়া সাগর, কৃষ্ণসাগর ইত্যাদিতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের ব্যাপক হারে নৌকাডুবিতে প্রাণহানি জাতি হিসেবে আমাদের দেশের মর্যাদাকে কোথায় ডুবিয়ে দিয়েছে তা কি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে?
নৌকাডুবি: নদী, হাওড়, লইছকা বিল ও ভূ-মধ্যসাগর সকল জায়গাতেই ঘটছে খুব ঘন ঘন। এর যেন কোন প্রতিকার নেই। সবাই প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো টাকা গোনে, কত ডলার এলো আর জমা হলো। কিন্তু এজন্য মুদ্রাস্ফীতির কথা মাথায় আনে না বিত্তশালীরা। দেশে বৈদেশিক রিজার্ভের অসমবস্থায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে নিম্নআয়ের মানুষের আরো বেশি নাজেহাল হচ্ছে তা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই।
অবৈধ পথে ওরা ভূমধ্যসাগরে লাশ হতে গেল কীভাবে? দেশের বাইরে ওদেরকে চুরি করে বের হবার সযোগ করে দিচ্ছে কোন বড় চোরেরা? অন্যায় পথে যাবার পথ করে দিল কে? সাগরডুবিতে লাশ হয়ে যাবার পর তারা কেউ তো আর তাদের খোঁজ নিতে এলোনা- গেল না! শুধু ওদের বাবা-মা, নিকট স্বজনরা একদিন-দু’দিন আহাজারি করলো। আর বিচার চাইলো, বুক চাপড়িয়ে টিভিতে ফটো তুলে বিলাপ করলো। তারপর সব ক্ষান্ত, সবকিছু শান্ত। আবার অপেক্ষা, কবে যেন নতুন আরেকটি বিলডুবি, হাওড়ডুবি, নদীডুবি বা সাগরডুবি হয়! দেশের পানিতে ডুবাডুবির ফলে মৃত্যুর কান্না বেশি ভারী না বিদেশের নীলজলে ডুবে লাশহারা স্বজনের কান্না বেশি ভারী তা কে অনুভব করবেন?
আরিফ বিল্লাহ্ লাশ দেখতে তার বাবা দাম্মাম থেকে আসছেন। জানি, বাবার কাঁধে ছেলের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। এত শোকের মাতম, এত ওজনের খাটিয়া আরিফের বাবার কাঁধে সইবে তো? বাকি ২১ জনের পরিবারের স্বজনদেরসহ সবাইকে এক সাগর সমান অথৈ পানির শোক সইবার শক্তি যেন মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন দান করেন।
আর চাইনা এমন খবর, চাইনা দেখতে এমন দৃশ্য গণমাধ্যমে। বিল, নদী, সাগর সব জায়গা থেকে নৌকাডুবি নামক মুছিবত দূর হয়ে সবার চলার পথের কাঁটা সরে যাক, এই শোকাবহ পরিবেশে আমরা এ কামনা করলেও অবৈধ আদমব্যাপারী নামক পিশাচরা শুধু টাকা গোনে আর মুচকি মুচকি হাসে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম