স্বপ্ন হলো সত্যি

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ৩০ আগস্ট ২০২১

মেট্রোরেল আমি প্রথম দেখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। মাটির নিচে ৫/৬ তলা পর্যন্ত নিচ দিয়ে ট্রেনের চলাচল আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। ছেলেবেলায় গ্রাম থেকে প্রথম ঢাকায় এসে আলো ঝলমলে শহর, উঁচু উঁচু ভবন, বড় বড় গাড়ি, ফোয়ারা, শাপলা চত্বর, দোয়েল চত্বর, গুলিস্তানের কামান দেখার যে বিস্ময়; বড় বেলায় মেট্রো রেল দেখার বিস্ময় তারচেয়ে কম ছিল না।

ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্ক গিয়েও মেট্রোরেলের বিস্ময়যাত্রা দেখেছি। তখন অল্প-স্বল্প ব্যবহার করেছি। তবে মেট্রো রেলে পূর্ণাঙ্গ ফায়দা আমি নিয়েছি নয়াদিল্লীতে। প্রথমবার দিল্লী গিয়ে কিছুই চিনি না। মেট্রো রেলের রুট চিনি না, নানান রং দেখে বিভ্রান্তি আরো বাড়ে। কোত্থেকে উঠবো, কোথায় নামবো জানি না। উল্টাপাল্টা হয়ে যাওয়ার ভয়ে মেট্রোরেলে কাছেও যাইনি। তাই দিল্লী দেখার কাজটা করেছি ট্যাক্সিতে, যা অনেক ব্যয়বহুল। এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন, দিল্লী মেট্রো ব্যবহারের। লজ্জায় তাকে নিজের বিভ্রান্তির কথাটি বলতে পারিনি। দিল্লী মেট্রো পুরো দিল্লীর বুকে জালের মত ছড়িয়ে আছে।

তুলনায় কলকাতা মেট্রো অনেক ছোট। কিন্তু তবু্ও আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাকাতার মেট্রোর ইতিহাসও বেশ পুরোনো। দ্বিতীয়বার দিল্লী যাওয়ার আগেই দিল্লী মেট্রো নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করেছি। গিয়েই একটা মেট্রো ম্যাপ জোগার করেছি। ব্যস, তারপর ইচ্ছামত দিল্লী ঘুরেছি পানির দরে। প্রথম বার দুইদিনে যত খরচ হয়েছিল, পরের বার ১০ দিনে খরচ হয়েছে তার অর্ধেক, সময় বেঁচেছে অনেক। মেট্রোরেল একই সঙ্গে সাশ্রয়ী, আরামদায়ক। সময়ও বাঁচায়, খরচও বাঁচায়।

এসব শহর দেখতাম আর আফসোস করতাম- ইশ যানজটে স্থবির ঢাকায় যদি মেট্রো রেল থাকতো। এই আফসোস আর আফসোস নেই। স্বপ্ন এখন সত্যি। এই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে আমাদের সবার চোখের সামনে। আমার অফিস কারওয়ানবাজারে। অফিসের জানালা দিয়ে মেট্রো রেলের উড়াল পথের নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখছি। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে রেলপথ। আমাদের অফিসের পাশের রাস্তার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু রেলের পাত বসবে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছিলেন, ‘যা আপনি ঘুমিয়ে দেখেন তা স্বপ্ন নয়; যা আপনাকে ঘুমাতে দেয় না, সেটাই স্বপ্ন।‘ তাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয় না। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সামর্থ্য লাগে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা লাগে, দূরদর্শিতা লাগে আর লাগে দুরন্ত সাহস। বাংলাদেশের সৌভাগ্য এই দেশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা নামে একজন দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক আর সাহসী মানুষ। তাইতো আমাদের ঘুমিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন এখন বাস্তব। এই তো গত সপ্তাহেই পদ্মা সেতুর সড়ক পথ সম্পন্ন হয়েছে। এখন হেঁটেই পদ্মা পাড়ি দেয়া সম্ভব। পদ্মার বুকে গাড়ি চলাচল এখন দৃষ্টিসীমায়।

বলছিলাম ঢাকার মেট্রোরেলের কথা। উত্তরা থেকে মতিঝিল আপাতত এই ২০.১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরোপুরি চালু হলে ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাবোয়া যাবে। দুইদিকে ২৪টি ট্রেন ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। রোববার উত্তরা থেকে পল্লবী পর্যন্ত রুটে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। আপাতত ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে।

ছয়মাস পরীক্ষামূলক চলাচল শেষে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে। আর তখন সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট কমবে, সময় বাঁচবে, পরিবেশ দূষণ কমবে। তবে ঢাকা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই একটি রুট দিয়ে হবে না, মেট্রোর রুট আরো বাড়াতে হবে। ঢাকার ওপর থেকে মাটির নিচে নিয়ে যেতে হবে রেল। মেট্রোরেল যেহেতু একবার এসেছে, এবার মাটির নিচেও তা নামবে। খালি নেতৃত্বে থাকতে হবে দূরদর্শী আর সাহসী কাউকে।

শুধু মেট্রোরেল নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে চলছে উন্নয়নযজ্ঞ। বিমানবন্দর থেকে কুতু্বখালী পর্যন্ত চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ। ৩০০ ফুট নামে পরিচিত পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের সম্প্রসারণ কাজ চলছে। ৩০০ ফুট তখন হয়ে যাবে হাজার ফুট। মেট্রোরেলসহ যেসব এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে, সেসব এলাকার মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এটা হলো, উন্নয়নের প্রসব বেদনা। তবে মনে রাখতে হবে প্রসব বেদনায় যেন প্রসূতির মৃত্যু না ঘটে। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুরের রাস্তায় প্রতিদিন লাখো মানুষের চলাচল। তাদের ভোগান্তির কোনো অন্ত নেই।

বছরের পর বছর ধরে চলছে নির্মাণকাজ। আমি জানি নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে মানুষ দুর্ভোগটা ভুলে যাবে। মেট্রো রেলে ব্যবসা হারানো মানুষও ট্রেন চলতে দেখে উৎফুল্ল। তবে মনে রাখতে হবে, যে কোনো উন্নয়ন কাজই শেষ করতে হবে দ্রুতগতিতে যাতে মানুষের দুর্ভোগটা দীর্ঘস্থায়ী না হয়। হাওরের বুক চিড়ে রাস্তা হওয়ার পর সেখানে যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই রাস্তা এখন পর্যটকদের প্রথম পছন্দ।

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গেলে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। মেট্রোরেলে যেদিন পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হলো, সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। নির্মাণ শেষ হলে এটি দেশের সবচেয়ে বড় রানওয়ে। বাংলাদেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত।

সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য বিমোহিত করে পর্যটকদের। পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো কোনো এলাকা তো সুইজারল্যান্ডকেও হার মানায়। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশের অনেক সৌন্দর্যই এখনও অনাবিষ্কৃত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন আর পার্বত্য এলাকা হতে পারে বিশ্ব পর্যটকদের পছন্দের স্থানে, বাংলাদেশের আয়ের বড় উৎস হতে পারে পর্যটন।

ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তা এখন চার লেনের। কর্নফুলি নদীর নিচের টানেল নির্মাণ হলে এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের রাস্তা বড় হলে কক্সবাজার আরো কাছে চলে আসবে। ব্যাকপেইনের কারণে আমার সড়কপথে চলাচল সীমিত। তাই এখন আর নিয়মিত কক্সবাজার যাওয়া হয় না। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেললাইন নির্মিত হলে কক্সবাজার আমার জন্যও অনেক কাছের হয়ে যাবে। পার্বত্য এলাকায় যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে।

শুধু মেট্রোরেল নয়, নানামাত্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একসময় যা ছিল স্বপ্ন, এখন তাই সত্যি হচ্ছে। আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসার দাবি করি। কিন্তু দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ বা ‘ সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি…’ গেয়ে আপ্লুত হওয়া নয়। সত্যি সত্যি দেশটাকে সোনার বাংলা বানাতে হবে, সত্যি সত্যি সকল দেশের রানী বানাতে হবে। সেটাই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। আর সেটা করতে হলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ করতে হবে।

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম

সত্যি সত্যি দেশটাকে সোনার বাংলা বানাতে হবে, সত্যি সত্যি সকল দেশের রানী বানাতে হবে। সেটাই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। আর সেটা করতে হলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ করতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।