নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু নেই ঢাকায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২৮ আগস্ট ২০২১

হঠাৎ করে বা অনেকদিন পর কেউ ঢাকায় এলে তার মনে হতে পারে এটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরী। তার বুঝতে বেগ পেতে হবে যে, এ রাজধানীটি আসলে উন্নয়ন বিধ্বস্ত। পৃথিবীতে এটিই একমাত্র শহর সম্ভবত যেখানে সারা বছর উন্নয়ন কাজ চলে।

বড় বড় সব উন্নয়নের পাশাপাশি চলেখোঁড়াখুঁড়ি, কাটাকাটি। অফিস, আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল বাড়ছে, কিন্তু রাস্তা বাড়ছে না। এখন উপরে নিচে পথ বানানোর বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। কিন্তু একটা দশক ধরে চলছে এসব কাজ, শেষ আর হয় না। কবে হবে সেটা এক উত্তরহীন প্রশ্ন। উন্নয়নকাজ চলতে থাকায় সব পথ এখন গলিতে পরিণত হয়েছে। সড়ক সংকীর্ণ হয়ে যানজট লেগেই থাকে।

নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বলে যে একটা বিষয় আছে, সেটা এই নগরবাসী কোনোদিন অনুভব করেনি, করবে বলেও মনে হয় না। বসতবাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বড় বড় অফিস ভবন। কিন্তু রাস্তা নেই। পানিপ্রবাহের জায়গা নেই। একটু ভারি বৃষ্টিতেই ভেসে যায় পুরো শহর।

এত ট্রাফিক জ্যাম কেন? এর সমাধানই বা কী? এসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। সমস্যাটা সবাই জানেন, কিন্তু সমাধান কারও জানা নেই বলেই মনে হচ্ছে। জানা থাকলেও উদ্যোগ নেই। প্রতিদিন নগরবাসী পথে বের হয়ে যে সাজা ভোগ করছেন, সেটা নিয়ে কোনো আলাপ কোথাও নেই।

যানজট সমস্যা মেটাতে বছরের পর বছর বৈঠক হয়, বড় বড় প্রকল্প হয়, ঠিকাদার, প্রকৌশলী আর আমলাদের পকেট স্ফীত হয়। সমস্যার একচুলও পরিবর্তন হয় না। ঢাকায় যানজট পরিস্থিতির উত্তরোত্তর অবনতি ঘটছে। এতদিন আমরা বলতাম কারও যদি একই দিনে ঢাকায় দুটি কাজ থাকে, তাহলে একটি হয়তো কোনো রকমে করা যায়। এখন একটি কাজও করা যাচ্ছে না। শহরের উন্নত জীবনের সংজ্ঞায় ঢুকে পড়েছে জীবনের গতি। কিন্তু এ শহরে কোনো গতি নেই। ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল অবস্থায় যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক৷ কয়েক ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকাই যেন এ শহরে সাধারণ নিয়ম।

গাড়ির সংখ্যা বাড়লেই যানজট হবে, এমন একটা কথা চট করে বলে দেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা। এমন ধারণা সহজ হতে পারে, কিন্তু সমীচীন নয়। পরিবহন অবকাঠামোর অপ্রতুলতা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা শহরকে যে উত্তরোত্তর গতিহীন করে তুলেছে সে কথা সরকারি নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করেন না। এতে করে সমাধানও হয় না।

এখানে নগরায়ণের প্রতিটি পর্যায়ে পাগলামি হয়েছে। হঠাৎ গতিশীল বাণিজ্যের পর্বে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের পরিমাণ বেড়ে চলছে রেকর্ড হারে। গত দুই দশকে যে হারে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, সে হারে রাস্তা বাড়েনি। একটি শহরের আয়তনের তুলনায় যে পরিমাণ রাস্তা থাকা দরকার ঢাকা শহরে তার তিন ভাগের একভাগও নেই। এর ওপর আছে জনঘনত্ব। সারাদেশে সুষম উন্নয়ন না হওয়ায় মানুষ সব প্রয়োজনে এখন ঢাকার দিকে ছুটছে। মাত্র ৮১৬ বর্গকিলোমিটারের এ শহরে বাস করে দুই কোটিরও বেশি মানুষ।

যাতায়াতে এ অসহনীয় পরিস্থিতির প্রধান কারণগুলোর একটি ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। সাথে আছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। ঢাকায় ঠিক কতো ধরনের যানবাহন চলাচল করে সেটার সঠিক কোনো হিসাব নেই কোথাও। সড়কে এ বিভিন্ন আকার ও গতিসীমার যানবাহনের চলাচল পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এমন 'হেটেরোজেনিয়াস ট্রাফিক' পৃথিবীর আর কোনো বড় শহরে নেই। বাইরের দেশগুলোতে দু-তিন ধরনের যান চলাচল করে, যেগুলোর গতিমাত্রা প্রায় একই। একই রাস্তায় ক্ষীণগতি ও দ্রুতগতির যান চলাচল এ শহরের বৈশিষ্ট্য। এ কারণে যানবাহনের চাপ সামলিয়ে গতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়েছে ঢাকা।

নানা প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এগুলো কোনোটাই যানজট কমাতে পারবে না। প্রয়োজন বিভিন্ন যানবৈচিত্র্য অনুযায়ী রাস্তার বিভাজন ও যান নিয়ন্ত্রণ। বাস, মেট্রোরেল, লোকাল ট্রেন, জলপথ পরিবহন— এগুলোর যথাযথ সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই সংঘবদ্ধ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সবাই বলে শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে অনেক। কথটা সত্য। তবে উন্নত বিকল্প তৈরি করতে না পারলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ঝোঁক কমানো যাবে না।

যেটুকু সড়ক আছে তার বড় একটা অংশ ব্যবহৃত হয় রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য। ফলে এ শহরের যৎসামান্য রাস্তার পুরোটাও ব্যবহার করা যায় না। এর সঙ্গে দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাতের পথচারীরা যখন রাজপথের একাংশকে ফুটপাতে পরিণত করে, সেই শহর যানজটের প্যাঁচে কুপোকাত হতে বাধ্য। শহরের যানের গতিতে বাড়তি প্রাণ সঞ্চার করতে অবিলম্বে বিকল্প পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শহরের মূল রাস্তাগুলো পূর্ণ ধারণক্ষমতার সদ্ব্যবহার ঘটতে পারে। মোটরযান ব্যবহার না করেই পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে অনেকেই কাজে যাবেন যদি ফুটপাতের হকারমুক্তি ঘটানো যায়।

দুটি করপোরেশন আছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের ভাবতে হবে, শহরকে গগনচুম্বী করার অনুমোদন দেওয়ার আগে পরিবহন অবকাঠামোর মতো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকার মতো এমন জঞ্জাল পরিবহন কাঠামোর আধুনিকীকরণের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই শহরের যান নিয়ন্ত্রণ ভাবনা দরকার। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা না করলে উন্নয়ন হয় না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম

দু’টি কর্পোরেশন আছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের ভাবতে হবে, শহরকে গগনচুম্বী করার অনুমোদন দেওয়ার আগে পরিবহন অবকাঠামোর মতো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকার মতো এমন জঞ্জাল পরিবহন কাঠামোর আধুনিকীকরণের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই শহরের যান নিয়ন্ত্রণ ভাবনা দরকার। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা না করলে উন্নয়ন হয় না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।