রোহিঙ্গা সমস্যার চার বছর বাস্তবতা ও ভবিষ্যত

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩২ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১

ব্রি. জে. হাসান মোঃ শামসুদ্দীন এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি,(এল পি আর)

তিন বছর পার হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা চার বছরে পড়েছে। গত বছর তিন বছর পূর্তিতে প্রত্যাবাসন ভাবনা নিয়ে লিখেছিলাম। তারপর থেকে মিয়ানমারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর দেশটিতে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ সালের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে জয়ী হয়েছিল। এন এল ডি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নির্বাচনী এলাকা থেকেও বহু আসন পেয়েছে। শুধু রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিতারনে যারা প্রচারনা চালিয়েছিল তাঁদের দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি)জয়লাভ করেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে নতুন সরকার কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখার আগেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে পহেলা ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। বর্তমানে দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী।

৩১ ডিসেম্বর ২০২০ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কর্ম অধিবেশনে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের পক্ষে নতুন ভাবে নয়টা দেশ ভোট দিয়েছে, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের এই নয়টি দেশ রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদের আগেকার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ১৩০টি ভোট আর বিপক্ষে ৯টি ভোট পড়েছে।। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ৯টি দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুবিষয়ক প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান না নিয়ে ভোটদানে বিরত থেকেছিল। মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও জাপানসহ ২৫টি দেশ প্রস্তাবের ভোটাভুটি থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ১৮ নভেম্বর ২০২০ এ জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি আনে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া, প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিসহ আরও কিছু বিষয়ে মিয়ানমারকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণ করার পর রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জরুরি বৈঠকের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।’জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক জানান, এখনো ৬ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে আছে, যাদের মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন শিবিরে অবস্থান করছে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রভাব ফেলবে এবং তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিতে পারে।

সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে নিয়ে আসায় মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। তবে এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষায় অভ্যুত্থান নেতাদের প্রতি দাবি জানিয়েছে গাম্বিয়া। সর্বশেষ সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ফের কথিত ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালাতে পারে বলে এক বিবৃতিতে গাম্বিয়া তাঁদের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং জানিয়েছেন যে তাঁর সরকার মিয়ানমারের চলমান বিদেশনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে যে চুক্তি আছে, তাতেও কোনো প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি না করে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা গ্রহণযোগ্য তাদের ফেরার অনুমোদন দেওয়া হবে।

২০২১ এর মার্চ মাসে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসিয়ানের মধ্যস্থতাসংক্রান্ত যে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, সেখানে রাখাইন রাজ্যের নাম না নেওয়া হলেও বাংলাদেশে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থানকারীদের সমস্যা (রোহিঙ্গা সমস্যা) সমাধানে আরও মনোযোগী হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সুপারিশে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ‘যাচাই–বাছাইয়ের’ পর প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে বলা হয়েছে এবং আসিয়ান সচিবালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতার পর এর জবাবদিহি নিশ্চিত এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতার পর ১২ জুলাই ২০২১, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রথম বারের মত কোনো প্রস্তাব ভোটাভুটি ছাড়া পাস হলো। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় অর্জিত এই সফলতা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মাইলফলক।

জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশের উদ্যোগে ওআইসি সব সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা, মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি পেশ করা হয়। ওআইসির ওই প্রস্তাবটিতে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এ ছাড়া তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া পর্যন্ত এ গুরুভার বহনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসহ সব ধরনের নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার আওতায় আনা এবং তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদার করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং আন্তর্জাতিকআদালতে চলমান বিচারপ্রক্রিয়াকেও সমর্থন জানানো হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলমান সব প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এখতিয়ারের কথা প্রস্তাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) সেনা প্রশাসনের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাখাইন প্রদেশে অং সান সু চির এনএলডি’র তেমন জনপ্রিয়তা নেই। বর্তমান সরকার আরাকানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতা করছে, অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও রাখাইনের সাতটি শহরাঞ্চলে এবং পাশের চিন রাজ্যে সেনাবাহিনী ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু করে দেয়। সামরিক জান্তা সরকার ২০২১ সালের ১১ মার্চ থেকে আরাকান আর্মিকে (এএ) সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে দেশটির সামরিক জান্তা সরকার। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি হামলা চালানো বন্ধ করে দেশজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে রাজি হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ এ’র অধিকাংশ সদস্যই রাখাইন নৃগোষ্ঠী ও স্থানীয় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।গত দুই বছরে বিদ্রোহী এ গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল।এ এ নভেম্বর ২০২০ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সাময়িক অস্ত্রবিরতির বিষয়ে সম্মত হয়েছিল।

রাখাইনে সামরিক জান্তা যেকোনো আলোচনায় এ এন পি এবং এ এ কে সংযুক্ত করতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের আলোচনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে এবং রোহিঙ্গা সংকট এত সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশকে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপের চলমান রাখার পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে আরও সক্রিয় হতে হবে। এ জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো অং সান সু চির দল এন এল ডিসহ দেশটির বিরোধী দলগুলো ১৬ই এপ্রিল ২০২১ একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ে তুলেছে যা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এন ইউ জি নামে পরিচিত। এন ইউ জি রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।গত ৩ জুন ২০২১ এন ইউ জি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেশ কয়েকটি অঙ্গীকার করা হয়েছে। এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা যে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতির পাশাপাশি যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। এই ঘোষণায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার আছে।সেই সঙ্গে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বিলোপের অঙ্গীকার করেছে।এই আইনের দ্বারা রোহিঙ্গাদের অধিকার হরণ করা হয়েছিল।

২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের রাজনীতিকদের এতটা খোলাখুলি রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি। এটি মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের তরফ থেকে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে 'রোহিঙ্গা' পরিচয়ের স্বীকৃতি। এন ইউ জি'র এই ঘোষণা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যেও আশাবাদ তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটাকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।

মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিবে বলে জানিয়েছে। তাঁদের সদিচ্ছাকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি।তবে তারা কিভাবে তা করবে এবং আদৌ তারা আরাকানের আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থন পাবে কিনা এসব বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়নের মত অবস্থা তাঁদের এখনও আসেনি। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদেরকে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং বাংলাদেশের স্বার্থে তা কাজে লাগাতে হবে।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের ওপর চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরের একটি প্রকল্প নিয়েছে এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ থেকে এ পর্যন্ত আট ধাপে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাকি ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার আগেই ভাসানচরের কাজে যুক্ত হবে জাতিসংঘ।

অন্যান্য দাতা সংস্থার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশকে সহায়তায় বিশ্বব্যাংক কাজ করছে, এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য যে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে তা রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত পাঁচটি চলমান প্রকল্পে ব্যয় হবে।

কি হয়নিঃ
আন্তর্জাতিক সংস্থা, আসিয়ান দেশগুলো সহ আঞ্চলিক দেশগুলো আরাকানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মত মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোন সেক্টরে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

কফি আনান কমিশনের সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করে আরাকানের অধিবাসীদের জীবনমান ও আর্থ সামাজিক অবস্থার কোন উন্নয়ন হয়নি।

আরাকানে চলমান সামরিক অভিযান এখন ও কার্যত বন্ধ হয়নি এবং আরাকানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের উপযোগী হয়নি।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দের মাঝে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতের বিষয়ে তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

আরাকানের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং তাঁদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা কিংবা যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

সব মিলিয়ে চার বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ তাঁর ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যাবাসন এখনও আলোর মুখ দেখছে না।

কি হতে পারেঃ
বর্তমানে মিয়ানমারের ছায়া সরকার, এন ইউ জি সামরিক শাসনবিরোধী দল ও ব্যক্তিদের একত্র করে একটি ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অবশ্য তাদের এ উদ্যোগ এখনো আন্তর্জাতিক সাড়া পায়নি। এ কায়দায় তাতমাদার মতো অভিজ্ঞ বাহিনীকে মোকাবিলা করা কঠিন। কিন্তু এ পরিস্থিতি মিয়ানমারকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং যার পরিণাম শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো অঞ্চলকে ভোগ করতে হবে।
মিয়ানমারের এ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রভাব ফেলবে। মিয়ানমারের অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে এই ১১ লাখ রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার বদলে নতুন শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যান্য শরণার্থীরাও যুক্ত হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আরও সতর্ক হতে হবে।

মিয়ানমারে সহিংসতা বেড়ে গেলে কিংবা গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তা নানা ভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে যা আমাদের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সুরক্ষাকে বিঘ্নিত করতে পারে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি সমাধান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জাতিসংঘের সক্রিয় আলোচনায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্বসম্প্রদায়ের রোহিঙ্গাদের প্রতি মনোযোগ যাতে না হারিয়ে যায় সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে নিজেদের আবাসস্থলে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃশ্যমান ও কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান চলমান রাখতে হবে।

কি করা যেতে পারেঃ
বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝে সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলমান এই সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা চলমান রাখতে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে প্রতি বছর ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে বিভিন্ন ভাষায় তা প্রচার করা যেতে পারে।

দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন , ইউ এন এইচ সি আর, আই ও এম, ডব্লিউ এইচ ও, নিরাপত্তা পরিষদ ও পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনগুলোতে রোহিঙ্গা সমস্যার নানা দিক নিয়ে যেমন নিরাপত্তা, পরিবেশ, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, নারী অধিকার, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন সংক্রান্ত আলোচনায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের ভুমিকা বিশ্বাসীর কাছে নিয়মিতভাবে তুলে ধরা।

মিয়ানমারে টেলিভিশনের ব্যবহার সীমিত, প্রকাশনা মাধ্যম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকায় রেডিও ই যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। কাজেই এই মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণের সাথে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব।এই মাধ্যম ব্যবহার করে রাখাইন প্রদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাঁদের মনোভাব সহনীয় করার বিষয়ে বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে।

দেশী বিদেশী পত্র পত্রিকায় কিছুদিন পরপর এই ইস্যুর অগ্রগতি নতুনভাবে তুলে ধরে তা জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা নেয়া।

বিদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের এ বিষয়ে আরও তৎপরতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা এবং কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মধ্য থেকে দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যায় রূপ নিতে পারে। এই সময়কালে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য, অর্থ এবং মানবিক সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে জাতিসংঘ এবং দাতা সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুদান চলমান রাখার বিষয়ে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও দাতাদের কে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দাতাদের সহযোগিতায় বার্মিজ ভাষায় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে ভবিষ্যতে মিয়ানমারের মুল জনস্রোতে মিশে যাওয়ার সক্ষমতা সৃষ্টি করতে হবে।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দান করেন। চলমান আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক নানা উদ্যোগ স্বত্ত্বেও গত চার বছরে মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দ্রুত থেকে দ্রুততর হোক, বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্ব এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা সেই আশায় অপেক্ষা করছে।

তথ্যসূত্রঃ
১। রোহিঙ্গা সমস্যার তিন বছর প্রত্যাবাসন ভাবনা ও অন্যান্য, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস, যায়যায়দিন, ৩০ আগস্ট ২০২০।
২। রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গ ছাড়ল ৯ দেশ, প্রথম আলো ২ জানুয়ারি ২০২১।
৩। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানে রাখাইনে উদ্বিগ্ন অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা, যুগান্তর, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৪। সামরিক অভ্যুত্থান: রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিয়ে শঙ্কা, যুগান্তর, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৫। মিয়ানমারের পরিস্থিতি আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে: মহিউদ্দিন আহমেদ, সরকার টু সরকার পর্যায়ে কথা বলতে হবে : তারেক শামসুর রেহমান * ছাড় দেওয়ার অবস্থাও তৈরি হতে পারে : অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, যুগান্তর, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৬। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি গাম্বিয়ার, যুগান্তর, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৭। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খুললেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান, যুগান্তর, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৮। বিক্ষোভ দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার মিয়ানমারে, যুগান্তর, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
৯। আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিল সামরিক জান্তা, যুগান্তর, ১১ মার্চ ২০২১।
১০। আসিয়ান, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংকট, এম সাখাওয়াত হোসেন, প্রথম আলো, ০৫ মে ২০২১।
১১। মিয়ানমারের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ ও আমাদের সতর্কতা, প্রথম আলো, আ ন ম মুনিরুজ্জামান, প্রথম আলো ০৮ জুলাই ২০২১।
১২। জাতিসংঘে রোহিঙ্গাবিষয়ক প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত, প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০২১।
১৩। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর জীবিকা সামগ্রী উপহার, রাহীদ এজাজ, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২১।
১৪। বেনেডিক, রজার্স (২০১২), বার্মা এ নেশন অ্যাট দা ক্রস রোড, রেন্ডম হাউজ, লন্ডন।
১৫। ভাসানচরে সহায়তার আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের রূপরেখা সামনে আনেন জাতিসংঘ কর্মকর্তারা, রাহীদ এজাজ, প্রথম আলো, ০৪ আগস্ট ২০২১।

লেখক : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক লেখক ও গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

গত চার বছরে মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দ্রুত থেকে দ্রুততর হোক, বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্ব এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা সেই আশায় অপেক্ষা করছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।