এলাকার লোকজন জোকের মতো কামড়াইয়া ধরছে
রজব আলী ঠিক করেছেন, সামনের আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। একথা তার ঘনিষ্ঠ যে ক’জন জানে, তাদের একজন কলিমদ্দি। এলাকার বন্যা পরিস্থিতির খবর জানিয়ে রজব আলীকে সে বলল-
: বস, ভোটারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার এইটা একটা চান্স।
: কীভাবে?
: বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে।
: বন্যা কি ঠিকমতো লাগছে?
: অচিরেই লাগবে বস।
কোনো বিষয়ে মত দেয়ার আগে গোঁফে হাত বোলানোর অভ্যাস রজব আলীর। আজও তাই করলেন। গোঁফ মোচড়ানো শেষে মুচকি হেসে তিনি বললেন-
: আগে লাগুক। পাবলিক দশ-বিশ দিন পানি-কাদায় হাবুডুবু খাক। তারপর তাদের কাছে আলোকবর্তিকারূপে দেখা দিব। বন্যার পানিতে পায়ের বুইড়া আঙুল ভেজার আগেই যদি খেদমত আলী হইয়া সেখানে হাজির হই, তাহলে পাবলিক বিষয়টা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। বুঝলা কলিমদ্দি, সাধা জিনিসের কদর নাই। যে জিনিসের প্রয়োজন যত বেশি, সেই জিনিসের কদরও তত বেশি।
সাতদিন পর কলিমদ্দি রজব আলীকে ভয়াবহ বন্যার খবর দিয়ে বলল-
: এইবার বোধহয় ফিল্ডে নামা যায়।
রজব আলী গোঁফপর্ব শেষ করে বললেন-
: হুট কইরা নামলেই হবে না। ফিল্ডে নামার আগে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এক নম্বরে বল, ত্রাণ হিসেবে কী কী বিতরণ করব?
: অন্য কিছু দেওয়ার চাইতে নগদ টাকা-পয়সা দেোয়াটাই উত্তম।
: তুমি যেইটারে উত্তম ভাবতেছ, আমি সেইটারে উত্তম মনে করতে পারলাম না। পাবলিকের হাতে নগদ টাকা দিয়া আসার দশ মিনিটের মধ্যেই তারা এনজিওর ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করার জন্য দৌড় দিবে। কিস্তি দেয়ার পর যে টাকা হাতে থাকবে, সেইটা দিয়া দোকান থেইক্যা বিড়ি কিইন্যা টানতে টানতে বাড়ির রাস্তা ধরবে।
: তাইলে চাল-ডাল দেন।
: চাল-ডাল, শাড়ি-লুঙ্গিও হাত বদল হইতে টাইম লাগে না। তাছাড়া তুমি চাইল-ডাইল দিলেই তো হবে না, সেইগুলা রান্না করার সুযোগও তো বন্যার্তদের থাকতে হবে।
: তাহলে কি রান্না করা খাবার বিতরণ করবেন?
: ঠিক ধরছ। এখন বল, খাবার বিতরণ করব কীভাবে?
: ইঞ্জিন বোটে।
: কার ইঞ্জিন বোট?
: যে কারও একজনের একটা ভাড়া নিলেই হবে।
: না, হবে না। খোঁজ নিয়া দেখতে হবে, ওই এলাকার কোনো মাতবরের কোনো ইঞ্জিন বোট আছে কিনা। যদি না থাকে, তাদের আত্মীয়স্বজনের কারও আছে কিনা। থাকলে সেই ইঞ্জিন বোট ভাড়া নিতে হবে। আর চাল-ডাল, লবণ-তেলও এইখান থেকে ক্রয় করা যাবে না। বন্যা দুর্গত এলকার প্রভাবশালী যে কয়জন ব্যবসায়ী আছে, তাদের একেকজনের দোকান থেইকা একেক আইটেম কিনতে হবে। সবার সঙ্গেই খাতির রাখতে হবে। কাউকে বেজার করা যাবে না। বুঝতে পারছ তো কী জন্য?
: জি, বুঝতে পারছি।
: এইবার যাও! এলাকায় গিয়া বিস্তারিত জাইনা আইসা আমারে জানাও। আমি এর মধ্যে অন্য কাজগুলা গোছগাজ কইরা ফেলি।
রজব আলী পাশের গ্রামে গিয়ে স্বভাব কবি বদিউলের খোজ করল। বদ্জিউলের ছেলে জানাল-
: আব্বা নদীতে মাছ ধরতে গেছে।
মোবাইল ফোনে ইমার্জেন্সি কল দিয়ে তাকে বাড়িতে ডেকে আনার পর রজব আলী জিজ্ঞেস করলেন-
: গান বান্ধার অভ্যাসটা কি ধইরা রাখছ? নাকি সব উইপোকায় খাইয়া ফেলছে?
: সংসারের ঘানি টানতেই জান যায়...
: আগামী তিনদিন নো ঘানি টানা। এই তিনদিন তোমার সংসার চালানোর ভার আমার। এই সময়কালে তিন-চাইরে বারটা গান লেইখা দিবা আমারে ।
: আপনে কি সিনেমা বানাবেন?
: না, না; সিনেমা না। তবে এর ক্যানভাসটা সিনেমার মতোই বিশাল। ডেব্বারচরে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণকার্য চালাবার নিয়ত করছি; বন্যার পানি না কমা পর্যন্ত প্রতিদিন খিচুড়ি বিতরণ কর্মসূচি। প্যান্ডেলের ভিতরে যখন খিচুড়ি রান্না হবে, তখন মাইকে তোমার লেখা গান বাজবে। নৌকায় করে খিচুড়ি বিতরণের সময়ও গান বাজানো হবে।
- কী ধরনের গান হবে স্যার?
: খুবই হৃদয়স্পর্শী। তোমারে একটা আইডিয়া দেই। এলাকার লোকজন আমারে জোকের মতো কামড়াইয়া ধরছে, আমি যেন সামনের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফাইট দেই। এই দিকটা মাথায় রাইখা সঙ্গীত রচনা করবা।
: নির্বাচনের চিন্তা মাথায় থাকলে নেতা-নেত্রীদের ভাষণ প্রচার করলেই তো হয়!
: আরে না! কার ভাষণ কে প্রচার করবে? আমি প্রফেশনাল পলিটিশিয়ান না। চান্দা দিয়া পার্টির নমিনেশন কিনতে হবে। কোন দল থেইক্যা নমিনেশন নিতে পারব, তার কোনো ইস্টিশন নাই।
: গানের কথাগুলা কি এমন হবে, লোকজন যাতে মনে করতে বাধ্য হয়, ত্রাণকর্তা তাদের পাশে আইসা গেছে।
: খালি পাশে না, গানগুলোতে এমন ভাষা, এমন উপমা প্রয়োগ করবা- যাতে মনে হয়, আমি একেবারে ভিতরে ঢুইকা গেছি। পাবলিক যেন মনে করে- আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব!
বদিউলের সঙ্গে কাজ শেষ করে রজব আলী বাজারে ঢুকলেন। কদ্দুসের চায়ের দোকানে বসে চা পান করতে করতে তাকে জিজ্ঞেস করলেন-
: এই বাজারে সবচাইতে ভালো ভিডিও রেকর্ডিংয়ের দোকান কোনটা?
কদ্দুস জবাব দিল-
: খোঁজ খবর নেওন লাগবে।
: এক্ষুনি খোঁজ লাগাও। সেইসঙ্গে একটা স্টুডিওতেও যাও। ভালো একজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করো। প্রতিদিন সকালে তারা দু’জন আমার সঙ্গে গাড়িতে কইরা স্পটে যাবে। বিকালে আইসা কাজ ডেলিভারি দিবে, যাতে সন্ধ্যার আগেই লোকাল পত্রিকা অফিসে প্রেস রিলিজ পাঠাইতে পারি।
: কিসের প্রেস রিলিজ?
: বন্যা উপলক্ষে ত্রাণ বিতরণ কর্মকাণ্ডের।
: আপনে নিজে এইসব করবেন, না কাউরে দায়িত্ব দিবেন?
: তোমারে ভিডিও ক্যামেরা আর ফটোগ্রাফার ভাড়া করার কথা বলার পরও তুমি বুঝতে পার নাই, এইখানে হিরো কে?
: বুঝতে পারছি ব্ইলাই জিজ্ঞাসা করছি। আপনে তো সাঁতার জানেন না!
: তাতে কী হইছে?
: বন্যার পানিতে প্রবল স্রোত থাকে। স্থানে স্থানে ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়। এ সময় সেখানে চলাফেরা করা খুবই ঝুকিপূর্ণ। বন্যার পানি নাইমা যাওয়ার পর কর্মসূচি গ্রহণ করলে সবদিক রক্ষা হয়।
: তখন কী বিতরণ করব?
: কৃষকদের সার দিবেন, বীজ দিবেন; ডায়রিয়ার স্যালাইন দিবেন।
: রান্নাবান্নার মধ্যে একটা হলুদ বাট, মেন্দি বাট ভাব ছিল। যেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করছিলাম, বাদ্য-বাজনা সহকারে তার প্রয়োগ ঘটাইলে বিষয়টা এলাকায় ব্যাপক সাড়া জাগাইত।
: বন্যা তো প্রতি বছরই হবে। পরিকল্পনা আগামী বছর বাস্তবায়ন করবেন। ততদিনে ভালোভাবে সাঁতারটা শিইখ্যা ফেলেন।
: এই বুড়াকালে সাঁতার শিখতে যাব?
: শেখার কোনো বয়স নাই।
পরদিন কলিমদ্দি এসে সবকিছু জানাল। কলিমদ্দির সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন রজব আলী। আসল বিষয় গোপন করে কলিমদ্দিকে তিনি বললেন-
: কলিমদ্দি, পরিকল্পনায় রদবদল ঘটাইছি।
: কী রকম?
: প্রি-পেইড থেইকা পোস্ট-পেইডে চইলা গেছি। গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানাইছে, তারা সবধরনের ত্রাণসামগ্রী লইয়া প্রস্তুত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাহিদাপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পাঠাইয়া দিবে। এইটা শোনার পর সরকারের ঘোষণারে সম্মান জানাইয়া ঠিক করছি, আমি বন্যা-পরবর্তী কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করব...
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস