আবারও বাংলাদেশকে নিয়ে কনফেডারেশনের স্বপ্ন!
ফারাজী আজমল হোসেন
‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’- সম্প্রতি এমনই এক স্লোগান দিয়ে শেষ হওয়া পাকিস্তান ডিফেন্সের ভিডিওর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব। এই ভিডিওতে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অসংখ্য মিথ্যাচার করার পাশাপাশি বিকৃত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। সেই সঙ্গে ভিডিওর শেষ ভাগে আশা প্রকাশ করা হয়েছে 'আবারও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনায় ফিরে যাবে'।
ঔদ্ধত্যপূর্ণ এমন এক ভিডিওতে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে শহীদ হওয়া ৩০ লাখের মানুষের বিষয়ে কোন মন্তব্য না করলেও মুক্তিযুদ্ধকে 'রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝি'র তকমা দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ম্লান করা অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। তাহলে কী এই দেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের সঙ্গে নিয়ে আরও একবার মুশতাক-জিয়ার স্বপ্নের পাকিস্তান কনফেডারেশন তৈরির স্বপ্নে বিভর পাকিস্তান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে মুশতাকদের মত অনেকেই ১৯৭১ সালে চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি করানোর দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব তোলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির এই প্রস্তাব অবশ্য কোনভাবেই সমর্থন করেনি বঙ্গবন্ধু নিজেও। কিন্তু তারপরও সেই চেষ্টা চালিয়ে যায় সে।
১৯৭১ সালে ব্যর্থ হলেও মুশতাক ব্যর্থ হননি ১৯৭৫ সালে। কেননা এ সময় তাকে সহায়তার জন্য পাশে ছিলেন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের চৌকস অফিসার হিসেবে পরিচিত জিয়াউর রহমান। তার প্রত্যক্ষ ইন্ধনের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরও কোন সামরিক বিদ্রোহ হয়নি। বরং তিন বাহিনী প্রধানের সমন্বয়ে দুর্দান্তভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন মুশতাক। যদিও তার কাছ থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নিতে বেশি সময় লাগেনি জিয়ার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মুশতাক এক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, 'জাতির সামনে ‘অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছেন'। ‘আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত’ সংগ্রামে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি, সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে রক্ষা করার সুযোগ এসেছে।” অর্থাৎ কখনই বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা তার উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষাই ছিলো তার লক্ষ্য। আর সেই পাকিস্তান কনফেডারেশন তৈরিতে খন্দকার মুশতাক, তার সহযোগী মাহাবুবুল আলম চাষী ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর ১৯৭১ সালে ব্যর্থ হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মাধ্যমে আবারো সুযোগ তৈরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীত স্রোতে গিয়ে তারা পাকিস্তানপন্থী পররাষ্ট্র নীতি ও রাজনীতি চর্চা শুরু করেন দেশে।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরদিন সকালে ঘাতক ডালিম বেতারে ঘোষণা দেয় যে, এখন থেকে বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে।’ কিন্তু সন্ধ্যায় খন্দকার মুশতাক অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি তার ভাষণে শুধু ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে শেষ করেন। যেটি ছিলো মূলত পাকিস্তানের স্লোগান।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর (১৯ আগস্ট) ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী সমর সেন মুশতাকের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান জানান। সেই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত মুশতাক আহমদের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে কোলকাতার ‘দ্য স্টেটসম্যান ‘সম্পাদক মানস ঘোষ লিখেছেন, 'সমর সেন ১৯ আগস্ট বঙ্গভবনে যান। এ সময় একখণ্ড কাগজ হাতে সমর সেনকে সরাসরি খন্দকার মুশতাকের কাছে দেখা যায়। মুশতাক দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন তার কূটনৈতিক নোট পড়ে শোনান। এই নোট শোনার পর খন্দকার মুশতাক বিমর্ষ মুখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।’
এই কূটনৈতিক নোটে লেখা ছিল : ‘যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোন দেশের সঙ্গে ‘কনফেডারেশন’ করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’ মূলত এ কারণেই মুশতাকের দ্বিতীয়বার কনফেডারেশনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এদিকে সরাসরি কনফেডারেশন ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে একটি উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন মুশতাক এবং বাংলাদেশকেও সেই ভাবধারায় চালিত করেন। ২৬ শে আগস্ট রয়টার্স প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, 'পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট প্রেরিত এক বার্তায় বাংলাদেশের নয়া রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারে স্বীয় ইচ্ছা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন।' পরদিন ২৭ আগস্ট খবরটি ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়।
মজাদার বিষয় হল, যেই ভিডিও নিয়ে আমার এত আলোচনা, সেখানে খুব সম্ভবত খন্দকার মুশতাকের সমঝোতার প্রস্তাবকে 'আওয়ামী লীগের প্রস্তাব' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ মুশতাক-ঠাকুর গং ছাড়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ বা অন্য কেউ এমন কোন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেননি। এটি মুশতাকের একান্ত ব্যক্তিগত এজেন্ডা ছিল, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুশতাক তার প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে আজও কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখছে পাকিস্তান যার মূল কারণ এই দেশে থাকা জামায়াত ও বিএনপির পাকিস্তানি দোসরেরা। এর শুরু অবশ্য বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। খন্দকার মুশতাকের হাত ঘুরে জিয়াউর রহমান লোক দেখানো ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেন। এ সময় বেশ স্পষ্ট হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেন এতো নিষ্ক্রিয় ছিলেন এই সামরিক কর্মকর্তা। অবশ্য নিষ্ক্রিয় বলা ভুল হবে, বরং বলা উচিত সেনা বাহিনী যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু করে না ফেলে সে বিষয়ে সদা সতর্ক দৃষ্টি ছিলো তার। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল সময়টাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে তার সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের জন্য। কিছুদিন পরপর সামরিক ক্যু এবং এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সেনা সদস্যদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পরবর্তীতে সবচাইতে বেশি সমালোচিত হয়েছে মেজর জিয়াউর রহমান। তার হাত ধরেই পাকিস্তানের দোসর জামায়াত ইসলাম রাজনীতি চর্চার সুযোগ পায় এই দেশে।
এই জামায়াত-বিএনপির হাত ধরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে জঙ্গিবাদ। শুধু নিজ দেশকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য করেই শান্ত হয়নি তারা। বরং বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতেও যেন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, সেই করিডোর তৈরি করে ভারতীয় চরমপন্থিদের নিয়মিত আশ্রয় ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে জামায়াত-বিএনপি। আজও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক এই গোষ্ঠীটির। লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত এই গোষ্ঠী আলোচনা করে যাচ্ছে বলেও শোনা যায়। তাহলে কী বাবার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণ করতে চান তারেক জিয়া? নাকি দেশের উগ্রবাদী ধর্মীও গোষ্ঠীকে উস্কে দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিজেদের কনফেডারেশন তৈরির কথা ভাবছে পাকিস্তান?
স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়, গড় জিডিপি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে শোষণকারী পাকিস্তানের কাছ থেকে। বাংলাদেশ যখন জঙ্গিবাদ দমনে জাতিসংঘের প্রশংসা কুড়াচ্ছে, তখন জঙ্গি অর্থায়নের জন্য অবরোধ প্রদান করা হচ্ছে পাকিস্তানকে। বিশ্বের অনেক দেশেই পাকিস্তানের পাসপোর্টধারীদের প্রবেশ নিষেধ। বর্তমানে আফগানিস্তানে চলা তালেবানদের নৃশংস অত্যাচার ও চীনের মুসলিম সম্প্রদায় উইঘুর নির্যাতনকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান জানান দিচ্ছে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান এবং ২০২১ সালের পাকিস্তানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। অবশ্য পুরো পাকিস্তান নিয়ে কথাটি বললে ঠিক হবে না, বরং বলা উচিত পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আচরণ আজও পরিবর্তন হয়নি। তখন বাংলাদেশের মানুষকে 'সাচ্চা মুসলমান নেহি হ্য' বলে ধর্ষণ, হত্যা এবং লুটপাট করেছে পাকিস্তানের মূর্খ সৈন্যরা।
আজও একইভাবে তারা ধর্ষণ, হত্যা ও লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও পাকিস্তান দখলকৃত কাশ্মীরে। তাদের এই অত্যাচার থেকে করাচী ও লাহোরের মানুষও রেহাই পায়না অনেক সময়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপের কারণে কখনও ইউনিফর্ম পরে আবার কখনও জঙ্গি বেশে এই হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তান।
পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ হিসেবে নিজেদের মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে, অথচ মুসলিমদের ওপর হওয়া নির্যাতন নিয়ে তাদের কোন মন্তব্য নেই। ইসলামের নামে হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করে দেশটি। যে দেশে এখনও নারীকে হত্যা করা হয় পরিবারের 'সুনাম' রক্ষার্থে সেই দেশ ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে নিজেদের ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কখনই সেই ধ্বংসের পথে হাঁটবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম