শোকে শক্তির শিল্পাঞ্জলি
রফিকুল ইসলাম
'বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হারাবার শোকের বেদনা আমার ভাল্লাগে না। তাই যে ডাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল ওই ৭ মার্চের দিনটিই শক্তির উৎস রংতুলিতে এঁকেছি।‘ আগস্ট বাঙালির শোকের মাস। ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতিসত্তার কবর রচনার মানসে স্বাধীনতাবিরোধীচক্র স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছাসহ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তন্মধ্যে ৭ মার্চের অগ্নিঝরা দৃশ্যটি ক্যানভাসে আনার কারণ এভাবেই বর্ণনা করেন শিশু চিত্রশিল্পী আয়ান।
আয়ানের পুরো নাম তাহসিনুল ইসলাম ভূঁইয়া আয়ান। বয়স ৫ বছর। মাতার নাম রেজিয়া তাসনুভা ঝুমুর ও পিতার নাম মো. শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া। মা শিক্ষকতা আর বাবা অধ্যাপনা করেন। একমাত্র বড় বোন সাদিয়া ইসলাম প্রভা নবম শ্রেণিতে পড়ছে; ও-ও মেধাবী ও সংস্কৃতিমনা। মা'র মতো সাহিত্যমনাও।
আয়ান শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ। যে কারণে কোনদিন যাওয়া হয়ে উঠেনি। এতে মনে নাকি বেজায় কষ্ট। ঘুরাঘুরি করতে পছন্দ করলেও ঘরবন্দি। এজন্য আফসোসের শেষ নেই, মনটাও ভারি খারাপ। কিশোরগঞ্জের হাওরের কেন্দ্রবিন্দু মিঠামইনে নানার বাড়ি হলেও বর্ষার অথৈ জলরাশি, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক রূপের হাওরে পাড়ি জমাতে পারছে না। সম্ভবও হয়ে উঠছে না হাওরের উত্তাল জলেভাসা একখণ্ড স্বর্গ পরিচিতি পাওয়া থাকা-খাওয়া ও বিনোদনের ব্যবস্থাসম্বলিত নির্মিত অত্যাধুনিক 'প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট'টি দেখার। এসবের ভন্ডুলের গোড়া নাকি ওই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। ক্ষণ গোনা হচ্ছে কবে 'নয়া আপদ' বিদায় হবে। তাই বলে আবার বসেও নেই, মানসিক বিকাশে ও দৃষ্টিভঙ্গি বৃদ্ধিতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়েই পরিপক্ক হয়ে উঠেছে আয়ান।
ছবি আঁকা আয়ানের শখ। যা আঁকে নিজ ভাবনার জগত থেকেই। সে মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও আগস্ট ট্রাজেডি শুনেছে মা-বাবার কাছ থেকে। শুনতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুই যে বাংলাদেশ, তা জানতে ও বুঝতে পারে। আবার আগ্রহের বাড়তি তথ্যের খোরাক জোগান দেন তার নানাভাই মিঠামইন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের দু'বারের প্রাক্তন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলম বাচ্চু। তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাগ্নে হন।
মা রেজিয়া তাসনুভা ঝুমুর আয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, আয়ান কারবালার ট্রাজেডির সাথে আগস্ট ট্রাজেডির সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ায়। মানবজাতির মৃত্য অনিবার্য পরিণতি হলেও এসব ট্রাজেডির সৃষ্টি মানসপটে ইতিহাস হয়ে যুগযুগান্তর বেঁচে থাকার জন্য। তাই বঙ্গবন্ধু চেতনায়, মন-মনন ও আশির্বাদে; শোকাগ্নে বা শোকাশ্রুতে নয়, অনির্বাণ শক্তিতে।
মানুষ তার চৈতন্যের ঊষালগ্ন থেকেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে যেসব মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, ছবি আঁকা এর মধ্যে অন্যতম। তাই শিশুরাও তাদের চৈতন্যের ঊষাকালে ছবি আঁকতে পছন্দ করে। শিশুরা বারো থেকে আঠারো মাস বয়স থেকে পেন্সিল বা প্যাস্টেল দিয়ে অসংখ্য হিজিবিজি লাইন দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করে।
শিশুদের ছবি হচ্ছে সৃজনাত্মক, বাস্তবধর্মী নয়। ছবি এঁকে তারা নিজেদের আবিষ্কার করে নানাভাবে। যেমন - কল্পনার রঙের প্লেট আর বাস্তবের রঙের প্লেট এক করে ফেলে। কারণ, শিশুরা কল্পনা আর বাস্তবের পার্থক্য বুঝে উঠতে পারে না। তাদের তুলি থেকে রঙ ঝরে পড়েই সাদা কাগজের ওপর বিম্বিত হয় তাদের না-বলা কথা; না-দেখা স্বপ্ন, মান-অভিমান, চেনা-অচেনা জীবনের নানা অনুষঙ্গ। এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙের সন্ধি ঘটিয়েই আগামী দিনের স্বপ্নগুলোকে গেঁথে ফেলে মনের অজান্তে।
সাদা পাতায় লীলাক কাজীর রঙিন ছবি আঁকার চেষ্টা শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই অনেকগুলো ভবিষ্যৎ মিলে পৃথিবী নামক এত বড় ক্যানভাসকে রাঙিয়ে দেবে নানা রঙের স্বপ্ন দিয়ে। এই নিষ্পাপ শিশুর আকাশ, বাতাস, মাটি, গাছ, ফুল, পশুপাখি, মানুষ, নদী সবখানেই রংধনুর সব রঙ গড়িয়ে আসে। তাদের আকাশ থাকে নানা রঙের পাখিতে মুখরিত। তাদের ফসলের মাঠে বাম্পার ফসল। তাদের নদীতে মাছের উপচেপড়া ভিড়। তাদের মানুষের মুখে রঙের প্রাচুর্য ঢের বেশি। কী সৃষ্টি সুখের উল্লাস তাদের মানসপটে!
এছাড়া পৃথিবীতে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ার উত্থান-পতন সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে শিল্প। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুসমূহ সৃষ্টি, স্থিতি, অবস্থা ক্রমবিকাশেন মধ্যে এবং যাবতীয় জাগতিক গুণ, মানবিক আবেদন আর জীবজগতের আচরণের মধ্যেও লুকিয়ে আছে শিল্প। আর সেইসব ঘটনাবলি চিহ্নিতরূপে ধরে রাখার জন্য ছবি আঁকার প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালের ছবি বিভিন্ন যুগের দর্পণ বা আয়না।
ছবির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতি আলো ফেলা যায়। গুহাচিত্রের পর এল মাটির দেয়াল, তালপাতা আর কাঠের পাটা। চিত্রপটে যুগে যুগে এল আদিম শিকারি জীবন, কৃষিকাজের যুগ, রাজা-বাদশাদের জীবন। আধুনিক যুগে এল দরিদ্র মানুষের কথা, আন্দোলনের কথা, সংগ্রামের কথা, লড়াইয়ের কথা, ছবিতে স্থান পেল মহাযুদ্ধের বিষয় আর যন্ত্রসভ্যতার কথা। শিল্পের গুণ ও গুরুত্ব ফুটে উঠল তখনই, যখন শিল্প মানুষের জীবনের দিককে তুলে ধরল।
শিশুরা স্বর্গের ফুল। তারা এই পৃথিবীকে সুবাসিত করার জন্য নেমে আসে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে। তারা বর্তমানকে সুন্দর করে তুলে। এক্ষেত্রে কবি কাহলিন জিবরানের অভিব্যক্তি তুলে না ধরলেই নয়।
কাহলিন জিবরান একবার এক নারীর কোলে শিশু দেখে ওই নারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'তোমরা তোমাদের ভালোবাসা তাদের দিতে পারো কিন্তু চিন্তা ভাবনা নয়, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা আছে। তাদের দেহ ধারণ করতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মা নয়। কারণ তাদের আত্মা বাস করে আগামীকালের গৃহে। সেখানে তোমরা যেতে পারো না, তোমাদের স্বপ্নেও না।'
সত্যিকারার্থে এই কোমল শিশুদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে সনাতনী প্রথায় অযাচিত কিছু চাপিয়ে দিলে তাতে তাদের স্বপ্নগুলো জীর্ণকায় হয়ে যায়। চারুকলা, কারুকলা, আবৃত্তি, তার্কিকতা, খেলাধুলা, লেখালেখি, প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা, বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদি শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে শিশুর মধ্যকার সুপ্ত সত্তা জাগরিত হয়। এসব সৃষ্টিশীল শিক্ষায় শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক দুটোরই বিকাশ ঘটে।
শিশুদের চিত্রের ভাষা খুবই সহজ-সরল। কারণ, তাদের জটিলতার অভিজ্ঞতা নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, 'বাল্যকাল থেকে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিন্তু নিতান্তই আবশ্যক, তাহাই কেবল কণ্ঠস্থ করিতেছে। তেমন করিয়া কোনমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না।'
তাই যেসব শিক্ষার্থীদের শুধুই পুঁথিগত গ্রন্থকীট হিসেবে তৈরি করা হয় বা কালের প্রণালী আঁকড়ে ধরে বসিয়ে রাখা হয়, তাদের আর যা-ই হোক মনের চর্চা হবে না।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিজেকে জানতে পারার জন্য একরকম আয়নাই বলা চলে। প্লেটো, সক্রেটিস, থেলিস, হেরাক্রিটাসের মতন দার্শনিকেরাও নিজেকে জানার প্রতিই জোর দিয়েছিলেন।
আঁকা ছবিটি ওই সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই পাওয়া। শোকের মাসে এরূপ ছবি দেখে চোখ বিস্ময়ে আটকে যায়। আর্টিস্টের AAYAN নামের বানানে বসানো ইংরেজি বড় অক্ষরগুলোর শৈল্পিক নৈপুণ্যতা দেখে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। তবে তুঙ্গে ওঠে তখন, যখন ক্যাপশনে বুঝা গেল শিশুশিল্পী।
শিশুশিল্পীর আঁকা ছবি দেখে স্বভাবই মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আসলে সবকিছুর পক্ষে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করলেই কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেকখানি। যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে কোনো বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে সৃজনশীলভাবে ভাবতে সাহায্য করে আর সেই জ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কেও ভাবায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে প্রাক শৈশব পর্যায়ের শিশুদের জন্য সিলেবাসের মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকে আর্ট। বাংলাদেশে বেশকিছু এনজিও সংস্থা আর্টের ওপরে তৈরি করে দিয়েছে তাদের নিজস্ব সিলেবাস।
ফেসবুক বা টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আঁকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেটা হচ্ছে শিল্পকে ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে। নিজের কোনো ছবি সম্পর্কে নানা মন্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজের সম্পর্কে অনেকখানি জানতে পারা এবং নিজেকে দেখার নানা দৃষ্টিভঙ্গিও জানতে পারা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে শিশুদের ছবি আঁকা প্রয়োজন কতটুকু। শিক্ষাব্রতী জ্যা জ্যাক রুশো এ কারণেই বলেন, 'Every chield is an artist by birth.' অর্থাৎ, 'প্রত্যেক শিশুই জন্মলগ্নভাবে শিল্পী।' ছবি আঁকা যে কেবল আঁকা, বিনোদন, সময়ক্ষেপণ, শখ নয় এবং ছবির মধ্য দিয়ে যে কেবলমাত্র একজন শিশু বা শিক্ষার্থীর মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যায় এমনও নয়। আবার মস্তিষ্কের গঠনে, এমনকি লেখাপড়ার বিভিন্ন বিষয়ে এই ছবি আঁকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তেমনটাও কিন্তু নয়; এ এটা আরো বৃহৎ একটি বিষয়।
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় দেখা গেছে, যে সকল শিশু ছবি আঁকার সাথে যত বেশি জড়িত, তারা তত বেশি আচরণের দিক থেকে সাবলীল। যেকোনও ঘটনা খুব সুন্দর করে বলতে জানে। এটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি চমৎকার গুণ বটে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।
এইচআর/জেআইএম