একা-পরীমনির সংবাদ ও গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫ কেজি স্বর্ণ কিংবা ১ লাখ ইয়াবাসহ এক যাত্রী ধরা পড়লো। এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারযোগ্য এবং প্রচার হয়ও। তবে পত্রিকার পাতায় ভিতরে স্থান হয় তার। যদি শেষ পৃষ্ঠায় জায়গা হয় তাহলে বড়জোর দুই কলাম বরাদ্দ। টেলিভিশন সংবাদে তার জন্য বরাদ্দ বড়জোর ১৫-২০ সেকেন্ড।
কিন্তু একই ঘটনা যদি কোনো সেলিব্রিটি ঘটিয়ে থাকেন কিংবা কোনো সেলিব্রিটির সন্তান বা পরিবারের কেউ ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নিশ্চিত স্থান পাবে। টিভিগুলো লাইভ করতে গিয়ে গলদঘর্ম হবে। এভাবেই আমাদের গণমাধ্যমগুলো অনেক সময়, অপরাধীর কর্ম প্রকাশ করতে গিয়ে অপরাধীর চেয়ে তার সেলিব্রিটি পিতা-মাতার নামটিই গুরুত্বসহ প্রকাশ করে। যেখানে হয়তো অপরাধীর পিতা কিংবা দাদা বহু আগেই পরপারের অধিবাসী হয়েছেন। যার সঙ্গে অপরাধের কোনো সংযোগও হয়তো নাই।
প্রশ্নটা সেখানেই। একজন অপরাধীর পিতা কিংবা দাদা হয়তো সমাজের মধ্যমণি ছিলেন, কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মের কোনো অপরাধ করলে তাকে সংবাদে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে কারণ কি? এটা তো স্বাভাবিক নিয়ম, অপরাধের সংবাদ প্রকাশ হবে আর তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে অপরাধীর নাম। কিন্তু যখন অপরাধীর চেয়ে তার সেলিব্রিটি নিকটজনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়, তখন প্রশ্ন আসতে পারে ওই মৃত কিংবা জীবিত ব্যক্তির সন্মান ক্ষুণ্ন করার দায় মিডিয়ার ওপর বর্তায় কি না। নাকি সন্তান-নাতির অপরাধ দায় নিতে হবে তাকেও।
অন্যদিকে সম্প্রতি পরীমনির বাসায় মাদক পাওয়া গেছে, তিনি মদপানের মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ধারণ করছিলেন, তার বাসায় মদের আড্ডা হতো তেমনি হেলেনা জাহাঙ্গীর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এমন অভিযোগই তাদের দুজনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ হয়েছে। দুজনের ক্ষেত্রেই দেখা গেল, সংবাদভাষ্যগুলো কিংবা টকশোতে ইনিয়ে বিনিয়ে রাজনীতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পের দিকেই চোখ রাখতে শুরু করেছে। অবস্থাটা যেন এমন-রাজনীতি করলেই হেলেনা জাহাঙ্গীরের মতো কথিত প্রতারণা কিংবা হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। আবার চলচ্চিত্র শিল্প মানেই হচ্ছে মদ আর মাদকের ব্যবহার কিংবা পর্নোগ্রাফির ব্যবসা। যদি বিশ্লেষণ করি, তখন দেখবো এখানেও অপরাধীর পারিবারিক পরিচয়ের মতো অপরাধীর পেশাগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অথচ পেশা এখানে অপরাধী নয়।
কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে আসছে। দেশবিখ্যাত এক ব্যবসায়ীর নাতিন প্রেমঘটিত কারণে একটি দুর্ঘটনায় জড়িয়ে যায়। পত্রিকাগুলো মৃত ব্যবসায়ীর নাম ব্যবহার করে ওই তরুণীর সংবাদটি প্রকাশ করে। ফলে তাদের পরিবারে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়, যা তাদের পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে আত্মীয়স্বজনকেও জড়িয়ে নেয়। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীর পুত্রবধূ ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এই নিবন্ধকারকেই বলেছিলেন, আমার মেয়ের সংবাদ প্রকাশ করাকালে যদি পারিবারিক পরিচয় দিতেই হয়, তখন তার বাবা কিংবা আমার নাম বড়জোড় প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তার দাদা বিখ্যাত মানুষ হওয়ায় মৃত এই ব্যক্তিকে জড়িয়ে ফেলা হলো সংবাদের সঙ্গে। এটা কি নৈতিকতাবিরোধী নয়?
এই দিকটি নিয়ে প্রায়শই সম্পাদকীয় নীতিমালায় পর্যালোচনা হয়। আমার জানামতে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে, আসলে পণ্যের বিক্রি বাড়াতে বাড়তি সংযোজন হিসেবে গণ্য হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংবাদমাধ্যম আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে হয়তো বলতে পারে, অপরাধী কম পরিচিত হলে তাদের সংবাদমূল্য বাড়াতে তারা অপরাধীর পরিবারের কারও নাম ব্যবহা করেছে। পাল্টা দিক হচ্ছে-অপরাধীকে সহজে পরিচয় করিয়ে দিতেই সংবাদ প্রকাশ?
হ্যাঁ, এমন যদি হয়, কোনো ব্যক্তির জীবদ্দশায় তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকেন আর বংশ পরম্পরায় যদি সেই অপরাধটি পরিবারের কেউ ধারণ করে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকের নাম যুক্ত হতে পারে। যেমন- কোনো রাজাকারের সন্তান যদি রাজাকারের আদর্শ ধারণ করে তখন তার বাবার নাম যুক্ত হতে পারে। সংবাদের প্রয়োজনে বাবার কীর্তিকাণ্ডও উল্লেখ হতে পারে।
এ নিবন্ধ লেখার সময় একাধিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, আসলে নীতি নৈতিকতার কথা চিন্তা করার সুযোগ থাকে কম। গণমাধ্যম শুধু চিন্তা করে পাঠক-দর্শককে আকৃষ্ট করা। সেটা যদি নেতিবাচক সংবাদসামগ্রীর ব্যবহার করলেও সম্ভব হয় তাই করছে গণমাধ্যম। আবার ভিন্নমতও পাওয়া গেছে। তা হচ্ছে- গণমাধ্যম সবসময়ই বৃহত্তর সংবাদ ক্রেতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অপরাধী কিংবা সংবাদের চরিত্র যদি পাবলিক ফিগার হয়ে থাকে তখন তার ব্যক্তিগত বিষয়টি অধিক মানুষের আকর্ষণের কারণ। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংবাদ চরিত্রের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়কেও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই অধিকসংখ্যক পাঠক দর্শকের খোরাক জোগানো।
তবে এমনটাও মনে আসে, প্রকাশের সুযোগ আছে বলে কিংবা পাঠক-দর্শকের চাহিদা থাকার পরও নগ্নতার মতো নেতিবাচক বিষয়কে প্রকাশের পক্ষে প্রায় সব গণমাধ্যম। কারণ এতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর অর্থ হচ্ছে- গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে। এ দায়বদ্ধতা পরীমনি, একা কিংবা হেলেনা জাহাঙ্গীরের সংবাদ প্রকাশের সময় কি আমরা দেখতে পেয়েছি? যে সংবাদ হয়তো ১৫-২০ সেকেন্ড পাওয়ার যোগ্য সেই সংবাদকে শুধু দর্শকচিন্তা করে আধাঘণ্টা পর্যন্ত বরাদ্দ করা হলো, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিশাল জায়গা দেওয়া হলো, তখন এই দায়বদ্ধতার বিষয়টি অধিকতর চিন্তার কারণ হতেই পারে। আবারও বলতে হয়, শুধু সুনামকেই ব্যবহারের দিকে নজর বেশি গণমাধ্যমগুলোর।
একের দোষ যে বিনা কারণে বহুতে গড়ায় এর একটি উদাহরণ দিই। ৯ আগস্ট পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে পরীমনির গাড়িচালক বলেছেন, তিনি পরীমনির গাড়ি তো চালাবেনই না এমনকি কোনো চলচ্চিত্র শিল্পীরও গাড়ি চালাবেন না বাকি সময়। তার মানে অবস্থাটা কী দাঁড়ালো? পরীমনির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন হলো, সেই অভিযোগ এখন গোটা চলচ্চিত্র শিল্পীর গায়ে গিয়ে পড়লো। এর পেছনে যদি গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে বলি, তাহলে কি বাড়িয়ে বলা হবে? পরীমনি কিংবা চয়নিকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে পারে কিংবা তার মতো আরও দু-একজনও যদি থাকে তাহলে কি গোটা চলচ্চিত্র অঙ্গনই এর দায় বহন করবে? এ নেতিবাচক প্রভাব কি অভিযুক্তর পেশাগত পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ মূল দায়ি নয়?
যেমন- হেলেনা জাহাঙ্গীরের প্রসঙ্গ আনতে পারি- তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তিনি প্রতারণা করেছেন। সংবাদ দেখে মনে করার শক্তিশালী যুক্তি আছে যে, হেলেনা জাহাঙ্গীর একাই সংবাদের বিষয়। প্রশ্ন এলেও সংবাদে যে বিষয়টি উল্লেখ নেই তা হচ্ছে প্রতারিত হওয়া চরিত্রটি। সংবাদগুলো হেলেনা জাহাঙ্গীরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তার দিকেই ক্যামেরা তাক করে থাকে। কিন্তু সংবাদ চরিত্র হিসেবে যে প্রতারিত ব্যক্তিটি অতি জরুরি, সেদিকে গণমাধ্যমের দৃষ্টি যায় না। শুধু পুলিশের তথ্যই অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভরসা হিসেবে কার্যকর হয়ে আসছে। গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব ধারায় ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। কিংবা তারা সেটা প্রয়োজন মনে করেও অনুসন্ধানে যুক্ত হচ্ছে না। তাহলে কি এটাও মনে করার কারণ আছে পাঠক-দর্শকের চাহিদা পূরণের জন্য যেনতেন চেষ্টা করাটাও গুরুত্ব পায় মিডিয়ায়।
সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের প্রত্যাশায় সবসময়ই মিডিয়ার কিছু অংশ সস্তা বিষয়ে বেশি ঝুঁকে। এমন একটি উদাহরণ শুনেছিলাম সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের কাছ থেকে। তিনি দ্য সান পত্রিকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। ওই পত্রিকাটি ৩০ বছর পর্যন্ত ভিতরের পাতায় ন্যুড ছবি ছাপতো। প্রচুর পাঠক পেয়ে যায় পত্রিকাটি। ট্রেনযাত্রী, বাস ও লঞ্চযাত্রীর মতো পাঠকরাই ছিল পত্রিকার টার্গেট রিডার। পত্রিকাটি তাদের সম্পাদকীয় নীতি পরিবর্তন করে ৩০ বছর পর। প্রধান শিরোনাম করে সেদিন ‘থারটি ইয়ার্স ইজ এনাফ’। এরপর থেকে ওইভাবে ন্যুড ছবি ছাপা বন্ধ করে দেয় তারা।
আমাদের গণমাধ্যমেও এমনি একটা পরিবর্তন আসা দরকার। কারণ অনেক সময় চলে গেছে, এখন সময় হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার, নীতি-নৈতিকতা ধারণ করে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/জিকেএস